তাহলে আমি কাজান শহরে চলেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেÍকম কথা নয়! বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার চিন্তাটা আমার মাথায় ঢুকিয়েছিল নিকোলাই ইয়েভরেইনভ নামে ইস্কুলের এক ছাত্র। ইয়েভরেইনভকে দেখলেই ভাল লাগে, সে খুবই প্রিয়দর্শন তরুণ, মেয়েদের মতো কোমল তার চোখদুটো। আমার সঙ্গে একই বাড়ির চিলে-কোঠায় থেকেছে সে। প্রায়ই আমার বগলে এক-আধখানা বই দেখে দেখে আমার সম্পর্কে ওর এত আগ্রহ জন্মায় যে আলাপ-পরিচয়ও করে নেয়। তারপর দু-দিন না যেতেই সে আমায় উঠে-পড়ে বোঝাতে থাকে আমার মধ্যে নাকি ‘অসাধারণ পান্ডিত্যের প্রকৃতিদত্ত সম্ভাবনা' রয়েছে। সজোর সুললিত ভঙ্গিতে মাথার লম্বা চুলগুলো ঝাঁকুনি দিয়ে পিছনে সরিয়ে সে বলত, ‘জ্ঞানবিজ্ঞানের সেবার জন্যই প্রকৃতি তোমায় সৃষ্টি করেছে।' খরগোশ হিসেবেও কেউ যে জ্ঞানবিজ্ঞানের সেবা করতে পারে সে-বোধ তখনও আমার জন্মায় নি, এদিকে ইয়েভরেইনভ কিন্তু আমায় জলের মতো সোজা করে বুঝিয়ে দিল যে বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি ঠিক আমার মতো ছেলেদেরই অভাব রয়েছে। পন্ডিত মিখাইল লমনোসভের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তটাও সঙ্গে সঙ্গে তুলে ধরল সে। ইয়েভরেইনভ বলল, কাজানে তার সঙ্গেই থেকে আমি শরৎ আর শীতের সময়টায় ইস্কুলের পাঠ একেবারে সড়গড় করে ফেলব, তারপর আমার ‘দু-চারটে' পরীক্ষা দিতে হবেÍ‘দু-চারটে', কথাটা সে ওইভাবেই বলেছিল; বিশ্ববিদ্যালয় আমায় বৃত্তি দেবে; এবং বছর পাঁচেকের মধ্যেই আমি একজন ‘বিদ্বান ব্যক্তি' হয়ে যাব। ব্যস্, জলবৎ তরলং। তা হবে না কেন, ইয়েভরেইনভের বয়েস ছিল উনিশ আর মনটাও ছিল দরাজ। পরীক্ষায় পাশ করে ইয়েভরেইনভ চলে গেল। হপ্তা দুয়েক বাদে আমিও রওনা হলাম। বিদায় নেবার সময় দিদিমা বলেছিলেন : ‘লোকের সঙ্গে রাগারাগি করিস নে। সবসময়ই তো রাগারাগি করিস! গোঁয়ার হতে চলেছিস, আর বদমেজাজী। এগুলো পেয়েছিস তোর দাদুর কাছ থেকে। আর তোর দাদুকে দ্যাখ না, কী ছিল সে? এত বছর বেঁচে রইল, অথচ কোথায় গিয়ে শেষ হল বেচারি বুড়ো! একটা কথা কিন্তু মনে রাখিস : মানুষের পাপপুণ্যির বিচার ভগবানে করে না। ও হল শয়তানের লীলা। আচ্ছা, আয় তবে...' তারপর ঝুলে-পড়া কাল্চে গালদুটোর ওপর থেকে এক-আধফোঁটা জল মুছে নিয়ে বললেন : ‘আর তো দেখা হবে না। তুই এখন ক্রমেই দূরে সরে যেতে থাকবি, অস্থির মন তোর। আর আমি বসে ওপারের দিন গুণব।” ইদানীং আমার আদরের দিদিমার কাছ থেকে একটু দূরে-দূরেই থাকতাম। খুব কম দেখা-সাক্ষাৎ হত, কিন্তু এখন যেন হঠাৎ একটা বেদনা অনুভব করলাম এই কথা ভেবে যে আমার এত আপন, এত ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুকে আর কোনোদিন দেখতে পাব না। জাহাজের গলুই থেকেআমি ফিরে চেয়ে ছিলাম ঘাটসিঁড়ির কিনারায় যেখানে দিদিমা দাঁড়িয়ে ছিলেন সেইদিকে। ক্রুশচিহ্ন তিনি করছিলেন এবং পুরন জীর্ণ শালের খুঁটটা দিয়ে গাল আর কাঁলো চোখদুটো মুছে নিচ্ছিলেনÍতাঁর সে চোখজোড়া মানুষের প্রতি অনির্বাণ ভালোবাসায় উজ্জ্বল। তারপর আমি এলাম এই আধা-তাতার শহরটায়, একটা ছোট্ট একতলা বাড়ির ছোট্ট কুঠরিতে। দারিদ্রক্লিষ্ট একটা সরু গলির শেষপ্রান্তে একটা নিচু টিলার ওপর একলা দাঁড়িয়ে এই বাড়িটার এক দিকে খোলা জমি পড়ে রয়েছে, ঘন আগাছায় ভরাÍএকসময় এখানে অগ্নিকান্ড হয়েছিল, দৃশ্যটা তারই সাক্ষ্য। সোমরাজ, আগ্রিমনি আর টক-পালঙের নিবিড় জঙ্গলের ভিতর এল্ডার-ঝোপে ঘেরা একটা ইঁটের পোড়োবাড়ি মাথা জাগিয়ে রয়েছে, ভগ্নস্তূপের নিচে একটা বড় খুপরি, তার মধ্যে রাস্তার কুকুরগুলো এসে আড্ডা গাড়ে, আর সেখানেই মরে। ওই খুপরিটার কথা আমার বেশ ভালোই মনে আছে : যত বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি পাঠ নিয়েছি তার মধ্যে ওই একটা। মা আর দুই ছেলে নিয়ে ইয়েভরেইনভ পরিবার। যৎসামান্য পেনশনে ওরা দিন চালাত। এ বাড়িতে আসার প্রথম দিনগুলি থেকেই আমি লক্ষ্য করেছিলাম ছোটখাটো ক্লান্ত চেহারার বিধবা মানুষটি বাজার থেকে ফিরে কী করুণ অবসাদেই না সওদাগুলো রান্নাঘরের টেবিলের ওপর বিছিয়ে বসে মাথা ঘামাতেন কঠিন এক সমস্যা নিয়ে : ছোট কয়েক টুকরো রদ্দি মাংস থেকে কেমন করে তিনটি জোয়ান ছেলের উপযুক্ত ভালো খাবার তৈরি করা যেতে পারেÍতাঁর নিজের কথা না হয় বাদই দেওয়া গেল! খুব কম কথার মানুষ। খাটিয়ে ঘোড়ার সব শক্তি নিঃশেষে ফুরিয়ে গেলে যে বিনীত অথচ নৈরাশ্য-ভরা জিদ তাকে পেয়ে বসে তারই চিহ্ন আঁকা হয়ে গেছে বিধবাটির ধূসর চোখদুটোর মধ্যে। চড়াই পথে গাড়িটা আপ্রাণ টেনে নিয়ে চলে বেচারি ঘোড়া, অথচ জানে কোনোদিনই চুড়োয় গিয়ে সে পৌঁছেতে পারবে না, তবু বোঝাটা টেনেই চলে! এখানে আসার তিন-চারদিন বাদে একদিন সকালে আমি রান্নাঘরে গিয়ে তাঁকে তরিতরকারি কুটতে সাহায্য করছিলাম। ছেলেরা তখনও ঘুমিয়ে। সাবধানে চাপা গলায় উনি আমায় জিজ্ঞেস করলেন : ‘এ শহরে এসেছ কেন?' ‘পড়তে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ব।'
(মার্চ ২৮, ১৮৬৮ – জুন ১৮, ১৯৩৬) বিখ্যাত রুশ সাহিত্যক। তিনি নিজেই তার সাহিত্যক ছদ্মনাম হেসেবে বেছে নেন 'গোর্কি' অর্থাৎ 'তেতো' নামকে। তার অনেক বিখ্যাত রচনার মধ্যে মা একটি কালজয়ী উপন্যাস। প্রথম জীবন মাক্সিম গোর্কি নিঞ্জি নভগরদ এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৯ বছর বয়সে পিতৃমাতৃহীন হন। ১৮৮০ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি তার দাদীমাকে খুঁজতে গৃহ ত্যাগ করেন। ১৮৮৭ সালে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে যান এবং দীর্ঘ ৫ বছর ধরে পায়ে হেঁটে সমগ্র রাশিয়া ভ্রমন করেন। তিনি ১৮ জুন ১৯৩৬ (৬৮ বছর) সালে মৃত্যু বরণ করেন।