বাংলাদেশ ধান গবেষণায় বেশ সফলতা পেয়েছে । কিন্তু এই সফলতার পিছনে আছে কয়েক হাজার বছরের অতীত । কিন্তু আমরা সে বিষয়ে তেমন সচেতন নই । এমনকি নিকট অতীতের ধান গবেষণায় পথিকৃত ড . এ আলীম এবং তার সহকর্মীবৃন্দকেও তেমন করে জানিনে । তারা আজ থেকে প্রায় ছয় দশক আগে A Review of Half a Century of Rice Research in East Pakistan শিরোনামে একটি সংকলন প্রকাশ করেছিলেন । সেখানে দূর অতীত না হোক নিকট অতীতের ( ১৯১০-১১ থেকে ১৯৬০ ) ধান - গবেষণা সংক্রান্ত অনেক কথাই ছিল । ২০১১ সালে ধান গবেষণার শত বছর পূর্ণ হয় । তখন আমি “ শতবছরের ” একটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম আমার “ ধান গবেষণা : শতবর্ষের কিছু কথা ” গ্রন্থে । সেখানে ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রদেশে কৃষি বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বিষয়ে কিছু কথা ছিল । পাশাপাশি বৈদিক যুগের কৃষি কেমন ছিল সে বিষয়েও সামান্য ইঙ্গিত ছিল । কিন্তু সেসব ইঙ্গিত বা আলোচনা যুগের প্রয়োজনে এখন আর যথেষ্ট মনে হয় না । সময় এগিয়ে যাচ্ছে ঝড়ের গতিতে । বিষয়টি মাথায় রেখে ব্রির পঞ্চাশ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে A Century of Rice Research in Bangladesh নামে আরেকটি গ্রন্থ রচনা করি । আমার সহলেখক ছিলেন ব্রির বর্তমান মহাপরিচালক ড . শাহজাহান কবীর ( Biswas and Kabir , 2022 ) । ২০২৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উক্ত অনুষ্ঠান উপলক্ষে ব্রি পরিদর্শনকালে গ্রন্থটির মোড়ক উন্মোচন করেন । সেটা ছিল ইংরেজি ভাষায় । আমি মনে করি বাংলা ভাষায় এমন একটি গ্রন্থের দরকার আছে । কারণ মাতৃভাষার বিকল্প নেই । ফলে সাধারণ মানুষগুলোও আমাদের ধান সংস্কৃতিকে বিস্তারিতভাবে জানতে পারবে । বর্তমান গ্রন্থটিতে সে চেষ্টাই করা হয়েছে । যাহোক দুটো গ্রন্থই ( A Century of Rice Research in Bangladesh এবং সেই থেকে ধান শব্দটি আমাদের ) আমার আগের গ্রন্থের ( ধান গবেষণা : শতবর্ষের কিছু কথা ) কাঠামোর উপর দাঁড় করালেও নতুন সংযোজনগুলো হলো ধান চাষের প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য , প্রাগ - বৈদিক যুগ থেকে বৃটিশ আমলে ধান গবেষণার বিবর্তনের কিছু খণ্ডচিত্র , প্রাচীন বাংলার ধান - সংস্কৃতি , আধুনিক ধান গবেষণায় পাশ্চাত্য প্রভাব , আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পিছনের খবর , সাড়া জাগানো IR৮ এর জন্ম ইতিহাস , ধান গবেষণায় ব্রির উদ্ভাবন , ব্রি ভিশন ২০৫০ , দেশের অর্থনীতিতে ধান গবেষণার অবদান , টেকসই উন্নয়নে ধান গবেষণার প্রোডাক্টিভিটি দ্বিগুণ করার উপায় , সাম্প্রতিক কালে ব্রিতে ব্যবহৃত আধুনিক গবেষণা - সুবিধাদির বিবরণ , ব্রি ছাড়া অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধান গবেষণায় অবদান ইত্যাদি । এছাড়াও দেশীয় জাত , জার্মপ্লাজম সংক্রান্ত অনেক তথ্য কেজিএফ ( কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন ) থেকে প্রকাশিতব্য “ দেশী ধানের জাত ” বই থেকে নেয়া হয়েছে । তাই গ্রন্থটিকে নতুন নামে অভিহিত করাই যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে। নামটি কবি নির্মলেন্দু গুণের “ স্বাধীনতা শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো ” নামক বিখ্যাত কবিতার শেষ পংক্তির অনুকরণ । কেবল স্বাধীনতার শব্দটির জায়গায় “ ধান ” শব্দটি বসিয়ে দিয়েছি । এজন্য আমি কবির কাছে কৃতজ্ঞ । ব্রি উদ্ভাবিত ধানের জাত সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য ব্রি থেকে প্রকাশিত আধুনিক ধানের জাত থেকে মোটামুটি অবিকৃতভাবে নেয়া হয়েছে । সাম্প্রতিক বিভাগীয় গবেষণা সংক্রান্ত তথ্য ও ছবিগুলো সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় প্রধানদের দেয়া । এজন্য আমি তাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞ । গ্রন্থটি প্রণয়নের সময় ঢাকা ফার্মের গবেষণা সংক্রান্ত তথ্য ড . আলীম ও তার সহযোগী গবেষণকবৃন্দ ( ১৯৬২ ) বিরচিত A Review of Half a Century of Rice Research in East Pakistan গ্রন্থ এবং বোরো ও আমন ধান সংক্রান্ত তথ্য নাগুরা ফার্ম ( হবিগঞ্জ ) থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন বছরের ( ১৯৩৪-১৯৪৪ ) গবেষণা প্রতিবেদনগুলো থেকে নেয়া হয়েছে । এছাড়াও শাস্ত্রীয় গ্রন্থাদি , মহাকাব্য , মধ্যযুগীয় কাব্য , ইতিহাস গ্রন্থ ইত্যাদি উৎস থেকে প্রযোজ্য তথ্যসমূহ এখানে সংযোজন করেছি । আমি তাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞ । আমি ইতিহাস , পৌরাণিক গ্রন্থাদি বা কাব্য - কাহিনী বিশেষজ্ঞ নই । তাই অনেক দুর্বলতা এখানে আছে । তবে জীবনের বেশ কিছুটা সময় আমার ধানের সাথে কেটেছে। সেটাই কিছু ভরসা। আমরা বলে থাকি ধান আমাদের প্রাণ , ধানই সমৃদ্ধি। ধান আমাদের রাজনৈতিক ফসলও বটে । অতএব ধানকে বিভিন্নভাবে আত্মস্থ করতে হবে । পল্লীকবি জসীম উদ্দীন এর ভাষায় - মোর ধানক্ষেত , এইখানে এসে দাঁড়ালে উচ্চ শিরে , মাথা যেন মোর ছুঁইবারে পারে সুদূর আকাশটিরে ! এইখানে এসে বুক ফুলাইয়া জোরে ডাক দিতে পারি , হেথা আমি করি যা খুশী তাহাই , কারো নাহি ধার ধারি । হেথায় নাহিক সমাজ - শাসন , নাহি প্রজা আর সাজা , মোর ক্ষেত ভরি ফসলেরা নাচে , আমি তাহাদের রাজা ।