মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ ও প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘জননী’। প্রকাশক কলকাতার কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স। প্রকাশকাল ১৯৩৫। অসাধারণ এ উপন্যাসটি শক্তিমান কথাসাহিত্যিকের অমর এক কীর্তি। নিগূঢ় মনঃসমীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণের ফসল এই অসামান্য মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে চিরন্তন ঘটমান বর্তমান মানব জীবনচক্রের স্বার্থক খণ্ডচিত্র। শ্যামা নামে এক গৃহবধূর জননী সত্তার বহুবিধ আত্মপ্রকাশ ‘জননী’র উপজীব্য। প্রথম প্রকাশকালে বিজ্ঞাপনে লেখা হয়েছিল-- “বাংলার জননী-- জীবনের অপূর্ব মৌলিক কাহিনী। সকল জন্মভূমি মৃত্তিকা, সকল জননী মানবী। মাটির মানুষের কাছে তাই জন্মভূমি স্বর্গের চেয়ে বড়, জননী বড় দেবীর চেয়ে! শ্যামাকে মানিকবাবু দেবী করেন নাই, জননী করিয়াছেন।” মানিক নিজেও লিখেছেন, “সংসারে এক জননীর চিত্র আঁকিতে গিয়া তাকে দেবী করিতে চাহিয়া মিথ্যা করিয়া দিব কেন?” ‘জননী’র কাহিনিতে অভিনবত্ব যতটা না তার চেয়ে বেশি চমৎকারিত্ব লেখকের গল্প বলার কৌশলে এবং ভাষা প্রয়োগের দক্ষতায়। প্রথম প্রকাশিত উপন্যাসেই মানিক পাঠকের সামনে ভাষার যে কারুকাজ নিয়ে হাজির হয়েছিলেন, পরবর্তীকালে সেই ভাষাশৈলীই তাঁকে বাংলাসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকে পরিণত করে।
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।