যাযাবরের "দৃষ্টিপাত" বাংলা গদ্য রচনায় একটি মাইল ফলক স্বরূপ। গত শতাব্দীর চল্লিশ দশকের গোড়ায় ভারতের স্বাধীনতা -সংক্রান্ত চুক্তির শর্তালোচনা করতে ব্রিটিশ প্রতিনিধি স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রীপ্স ভারতে আসেন। তাঁর ভারত সফর কভার করতে এক বিদেশি সংবাদপত্রের দেশীয় সাংবাদিক হয়ে লেখক দিল্লি যান। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি দিল্লিকে দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে রচিত হয়েছে "দৃষ্টিপাত"। সাংবাদিকের চোখ বিষয়বস্তুর যোগান দিয়েছে, গভীর রসবোধ ও অনায়াস ভাষায় কাগজে আঁচড় কেটেছে সুসাহিত্যের কলম। ফলাফল যা হয়েছে তাতে নালিশ করার কিছুই নেই। ইতিহাস আছে,ভূগোল আছ, উইট-হিউমার আছে,ব্যঙ্গ বিষাদ আছে,ব্যক্তি আছ, দেশ আছে— আর যে কি কি আছে বলে বুঝানো যাবেনা। সবমিলিয়ে পাঠকের কাছে এক অত্যুতকৃষ্ট সাহিত্য ব্যন্জন। " বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ,কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ"—এই উদ্ধৃতি কালের সীমা পেরিয়ে আজ ও আমাদের মনের মণিকোঠায় অনুরণন তোলে, `তাতে আছে গতির আনন্দ, নেই যতির আয়েশ'। আছে ততকালীন আই.সি.এস-দের নিয়ে সেই ক্লাসিক স্যাটায়ার। "শাস্রকারেরা বলেছে, রাজদর্শনে পূণ্যলাভ। অমাত্য দর্শনে পূণ্য আছে কিনা জানিনে। বোধহয় আছে। নইলে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলরদের বাড়িতে প্রত্যহ ভিড় জমে কেন। ভিড় জনতার নয় আ.সি.এস---দের। `প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয় মহিমা। কিন্তু—প্রবন্ষিতকে দেয় কী? তাকে দেয় দাহ। '
বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত সর্বপ্রথম ক্রিকেট নিয়ে গ্রন্থ রচনা করেন বিনয় কুমার মুখোপাধ্যায় । বাংলার পাঠকসমাজে তিনি "যাযাবর" নামে তিনি অধিক পরিচিত । "যাযাবর" হল বিনয় কুমার মুখোপাধ্যায়ের ছদ্মনাম। বিনয় কুমার মুখোপাধ্যায় ছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক, গীতিকার এবং সাংবাদিক । এই শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক 1908 সালে জানুয়ারী মাসের 10 তারিখে অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত ঢাকা জেলার ফেগুনামার গ্রামে ভুমিষ্ঠ হন । এই শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিকের পিতার নাম হল ফণীভূষণ মুখোপাধ্যায় এবং মাতার নাম হল মনোরমা দেবী । এই শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক চাঁদপুরের জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক, সেন্ট পলস কলেজ থেকে আই. এ. এবং বঙ্গবাসী কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করেন । সেই সময় এই শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক কয়েকটি সঙ্গীত রচনা করেছিলেন । সুরসাগর হিমাংশু দত্ত সুরারোপিত তার সঙ্গীতের রেকর্ডের তালিকা ছয়টি । কাজের প্রয়োজনে দিল্লি গমন করা এবং হিমাংশু দত্তের অকাল প্রয়ানে এই শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিকের গীতিকার জীবনে সমাপ্তি ঘটে । এই বরণীয় সাহিত্যিক যুগান্তর পত্রিকায় সাংবাদিক হিসাবে যোগ দিয়ে কর্মজীবন আরম্ভ করেন । এই পত্রিকায় এই বরণীয় সাহিত্যিক "শ্রীপথচারী" ছদ্মনামে রাজনৈতিক কলম লিখতেন । চাকরিজীবনে এই বরণীয় সাহিত্যিক ভারত সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের উচ্চ পদস্থ কর্মচারী ছিলেন এবং পরে প্রেস কাউন্সিলের সচিব হয়েছিলেন । এই পদ থেকেই বিনয় কুমার মুখোপাধ্যায় অবসর গ্রহন করে কর্মজীবন শেষ করেন । এই বরণীয় সাহিত্যিক কর্মজীবনেই সাহিত্য রচনা আরম্ভ করেন । "যাযাবর" ছদ্মনামে রচিত এই স্বণামধন্য সাহিত্যিকের প্রথম উপন্যাস "দৃষ্টিপাত" 1946 সালে প্রকাশিত হয় । এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়া মাত্রই বাঙালি পাঠকমহলে একটা আলোড়নের সৃষ্টি হয় । গ্রন্থপ্রেমীদের মধ্যে এই উপন্যাসটি পড়েন নি এমন বাঙালি সেই সময় খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল । "দৃষ্টিপাত" উপন্যাসটি এই স্বণামধন্য সাহিত্যিককে এতোই জনপ্রিয়তা দান করে যে শোনা যায়, সেই সময় তরুন - তরুনীদের প্রেমপত্রে তার লেখার উদ্ধৃতিগুলি ব্যবহার হতো । ছোটগল্প ও উপন্যাস মিলিয়ে এই স্বণামধন্য সাহিত্যিকের গ্রন্থসংখ্যা ছয় । এই গ্রন্থগুলি হল - দৃষ্টিপাত, জনান্তিক, ঝিলম নদীর তীরে (কাশ্মীরে হানাদারদের আক্রমন নিয়ে রচিত এই গ্রন্থ), লঘুকরণ, হ্রস্ব ও দীর্ঘ এবং যখন বৃষ্টি নামলো । "দৃষ্টিপাত" উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার আগে মাসিক বসুমতী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল । 1950 সালে সমকালীন বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসাবে "দৃষ্টিপাত" দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারা নরসিংহ দাস পুরস্কারে সম্মানিত হয় । 1960 সালে "দৃষ্টিপাত" উপন্যাসটির হিন্দী অনুবাদ প্রকাশিত হয় । পরবর্তীকালে অন্যান্য কয়েকটি ভাষাতেও এই উপন্যাসটি অনুদিত হয়েছে । বাংলা ভাষায় ক্রিকেট নিয়ে এই জনপ্রিয় সাহিত্যিকের রচিত দুইটি গ্রন্থ "খেলার রাজা ক্রিকেট" এবং "মজার খেলা ক্রিকেট" বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । এই প্রথিতযশা সাহিত্যিকের রচিত সব কয়টি গ্রন্থই জনপ্রিয় হয়েছিল । এই জনপ্রিয় সাহিত্যিক আর কেন গ্রন্থ রচনা করেন নি তা নিয়ে পাঠকদের মনে ক্ষোভ আজও আছে । এই খ্যাতনামা সাহিত্যিক নিজের সাহিত্যকীর্তির জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে বিদ্যাসাগর পুরস্কার লাভ করেন । 2002 সালে অক্টোবর মাসের 22 তারিখে বর্তমান ভারতবর্ষের অন্তর্গত দিল্লি শহরে এই খ্যাতনামা সাহিত্যিকের তিরোধান হয় ।