ভূমিকা গত পঁয়ত্রিশ বছরে আমেরিকার প্রকাশনা জগৎ দু লাখের উপর নানা ধরনের বই প্রকাশ করেছেন। এর বেশির ভাগই অপাঠ্য আর অর্থকরী ভাবেও ব্যর্থ। অনেক বললাম বটে, আসলে একজন নামজাদা প্রকাশন প্রতিষ্ঠানের প্রধান আমায় বলেছেন যে তাঁর প্রতিষ্ঠান ৭৫ বছরের অভিজ্ঞতায় প্রতি আটখানি বই প্রকাশের পর সাতটিতেই লোকসান দিয়ে চলে। তাহলে, আমি আবার একখানা বই লেখার মত হঠকারিতা করছি কেন? আর এ বই লেখার পর আপনিই বা তা পড়তে যাবেন কেন? দুটো প্রশ্নই যথার্থ, তাই আমিও এর উত্তর দেবার চেষ্টা করবো। প্রায় ১৯২২ সাল থেকেই আমি নিউইয়র্কের ব্যবসায়ী আর পেশাদার স্ত্রী পুরুষের জন্য নানা ধরণের শিক্ষাদানের কাজ করে আসছি। প্রথম প্রথম আমি শুধু জনগণের সামনে বক্তৃতা দেওয়ার ব্যাপারে শিক্ষা দিতামÑএই শিক্ষণ ব্যবস্থা বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বয়স্কদের নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আরও সুন্দরভাবে নিজেকে প্রকাশের জন্যই, আর সেটা ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে বা জনসমাবেশের সামনে যাই হোক। তবে আস্তে আস্তে সময় কেটে চললে উপলদ্ধি করলাম এই প্রাপ্তবয়স্কদের আসলে যা দরকার তা হলো কথা বলার যোগ্যতা প্রাত্যহিক কাজে কর্মে আর সামাজিক যোগাযোগের ব্যাপারে জনসংযোগের জন্য তাদের আরও বেশি শিক্ষা দরকার। আস্তে আস্তে আমি এটাও বুঝলাম আসলে এরকম কিছু শিক্ষা আমার নিজেরই একান্ত দরকার। পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে আমি হতবাক হয়ে দেখি বারবার কৌশল আর উপলব্ধির কি অভাবই না আমার রয়ে গেছে এই ব্যাপারে। আহা! এমন একখানা বই যদি বিশ বছর আগে আমার হাতে পড়তো। তাহলে কি আশাতীত আশীর্বাদের ব্যাপারই না হতো। জনসংযোগের কাজই বোধ হয় সবচেয়ে বড় সমস্যা, বিশেষ করে আপনি যদি ব্যবসাদার হন। আর এটা আপনি যদি গৃহকর্ত্রী, স্থপতি বা প্রযুক্তিবিদও হন তাহলেও সত্য। কয়েক বছর আগে শিক্ষকদের উন্নতির জন্য কার্নেগী ফাউ-েশনের আনুকুল্যে এক অনুসন্ধানের ফলে খুব গুরুত্বপূর্ণ আর অর্থপূর্ণ ব্যাপার প্রকাশ পায়Ñযে ব্যাপারটা পরে কার্নেগী ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে আরও গবেষণায় সমর্থিত হয়। এই গবেষণায় আরও প্রকাশ পায় যে ইঞ্জিনীয়ারিংয়ের মত কারিগরী বিষয়েও যে কোন মানুষের অর্থকরী সাফল্যের শতকরা ১৫ ভাগ নির্ভরশীল তার কারিগরী জ্ঞানে উপর আর প্রায় শতকরা ৮৫ ভাগ মানবিক জ্ঞানের উপরÑএটা হলো তার ব্যক্তিত্ব আর মানুষকে পরিচালিত করার দক্ষতার উপর। বেশ কয়েক বছর ধরে প্রতি শিক্ষাবর্ষে আমি ফিলাডেলফিয়ার ইঞ্জিনীয়ার্স ক্লাব আর নিউইয়র্কের আমেরিকান ইনস্টিটিউটের ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনীয়ারদের শিক্ষাদান করেছিলাম। প্রায় ১৫০০ ইঞ্জিনীয়ার আমার ওই শিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। তারা আমার কাছে আসেন যেহেতু তারা বেশ কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলেন যে ইঞ্জিনীয়ারিং দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি আয়ের মানুষেরা প্রায় যারা ইঞ্জিনীয়ারিং-এ অভিজ্ঞ তারা হন না। উদাহরণ হিসেবে, যে কেউ ইঞ্জিনীয়ানিং, হিসাবশাস্ত্র, স্থাপত্যবিদ্যা বা অন্য যে কোন পেশাতেই সপ্তাহে পঞ্চাশ থেকে পঁচাত্তর ডলার ব্যয় করে কিছু প্রযুক্তি দক্ষতা অর্জন করতে পারে। বাজারে এদের শ'য়ে শ'য়ে মেলে। কিন্তু যে লোকের প্রযুক্তিজ্ঞানের সঙ্গে মনোভাব প্রকাশ করার ক্ষমতা, নেতৃত্ব দেবার শক্তি আর মানুষের মধ্যে উৎসাহ জাগানোর ক্ষমতা আছেÑসেই ব্যক্তি নিঃসন্দেহে বেশি উপার্জনের ক্ষমতা রাখেন। জন ডি. রকফেলার তার কর্মকা-ের সেরা সময়ে ম্যাথু সি. ব্রাশ'কে বলেছিলেন যে, ‘জনসংযোগের কাজে দক্ষতা চা বা কফি কেনার মতই কেনা যায়। আর আমি এই ক্ষমতার জন্য অন্য যে কোন বস্তুর চেয়ে বেশি ব্যয় করতে রাজি।' আপনাদের কি মনে হয় না দেশের প্রতিটি কলেজেই এই ধরণের শিক্ষাদানের মধ্য দিয়ে সবচেয়ে দামী এই ক্ষমতা বিকাশের ব্যবস্থা থাকা দরকার? কিন্তু দেশের অন্ততঃ একটা কলেজেও এই ধরণের কোন ব্যবহারিক, সহজবোধ্য প্রাপ্তবয়স্কের উপযোগী শিক্ষণ-ব্যবস্থা আছে কি না তা আমার এই বই লেখার সময় পর্যন্ত নজর এড়িয়ে গেছে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় আর সমস্ত ওয়াই. এম সি. এ. বিদ্যালয়গুলো প্রাপ্তবয়স্করা সত্যিই কি শিখতে আগ্রহী স্থির করার জন্য যুগ্মভাবে এক সমীক্ষা চালিয়েছিল। এই সমীক্ষা চালাতে খরচ হয় ২৫০০০ হাজার ডলার আর সময় লাগে দু বছর। সমীক্ষার শেষ অংশ চালানো হয় কানেকটিকাটের মেরিডেনে। শহরটিকে বেছে নেওয়া হয় যেহেতু এটি বৈচিত্র্যময় কোন আমেরিকান শহর বলেই। মেরিডেনের প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্কদের সাক্ষাৎকার নিয়ে তাদের ১৫৬টি প্রশ্নের জবাব দিতে অনুরোধ করা হয়Ñপ্রশ্নগুলো ছিল এই ধরণের : ‘আপনার পেশা কি? শিক্ষা কতদূর? আপনি অবসর সময় কিভাবে কাটান? আপনার আয় কত? আপনার শখ কি? আপনার উচ্চাকাক্সক্ষা কি? সমস্যা কি রকম? কি ধরনের বিষয় আপনি পড়তে আগ্রহী?' ইত্যাদি। ওই সমীক্ষায় প্রকাশ পায় প্রাপ্তবয়স্কদের প্রধান আগ্রহ স্বাস্থ্য সম্বন্ধেÑআর তাদের দ্বিতীয় আগ্রহ হলো মানুষ, অর্থাৎ কিভাবে মানুষকে বোঝা যায় আর তাদের নিয়ে চলা যায়, কিভাবে তাদের নিজের মত গড়ে তোলা যায় আর কিভাবে অপরকে জয় করে স্বমতে আনা যায়। যে সমিতি ওই সমীক্ষা চালিয়েছিলেন তারা ঠিক করলেন এই ধরণের কোন পাঠক্রম মেরিডেনের বয়স্কদের জন্য চালু করবেন। এর পর তারা বেশ পরিশ্রম করেই এই বিষয়ের কোন ব্যবহারিক পাঠ্য বইয়ের খোঁজ করেত চাইলেনÑকিন্তু সে রকম কোন বই পাওয়া গেল না। শেষ পর্যন্ত তাঁরা পৃথিবীর প্রথিতযশা কোন বয়স্ক শিক্ষণ বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়ে জানতে চাইলেন ঐ উদ্দেশ্য সাধনের উপযোগী কোন বইয়ের কথা তাঁর জানা আছে কি না। তিনি জবাবে জানালেন, ‘না। আমি জানি বয়স্করা কি চান। তবে যে বই তাদের দরকার তা আজও লেখা হয় নি।' আমার অভিজ্ঞতায় আমি জানি কথাটা সত্যি, কারণ আমি নিজেই বেশ কয়েক বছর ধরে মানবিক সম্পর্কে উপর লেখা ব্যবহারিক একখানা বই খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছি। যেহেতু এরকম কোন বইয়ের অস্তিত্ব ছিল না, আমার নিজের তৈরি পাঠক্রমের জন্য আমি যে বই লেখার চেষ্টা করেছিÑএই সেই বই। আশা করি আপনাদের এটা ভালো লাগবে। এ বই লিখতে গিয়ে, ওই বিষয়ের উপর লেখা যা আমার নজরে এসেছে তাই পড়েছিÑএবং তা ডরোথী ডিক্সের লেখা, বিবাহ-বিচ্ছেদের বর্ণনা, ‘পেরেন্টস' ম্যাগাজিন থেকে প্রফেসর ওভারস্ট্রীট, অ্যালফ্রেড অ্যাকলার আর উইলিয়াম জেমসের রচনা পর্যন্ত। এ ছাড়াও আমি একজন অভিজ্ঞ গবেষকের সাহায্য নিইÑনানা গাঠাগারে আমি পড়তে পারিনি এমন সব বই তিনি প্রায় দেড় বছর ধরে ঘেঁটেছেন। সে সব বইয়ের মধ্যে ছিল মোটা মোটা মনোবিজ্ঞানের বই, শ'য়ে শ'য়ে সাময়িক পত্রের প্রবন্ধ ইত্যাদি। অসংখ্য জীবনী ঘেঁটেও তিনি জানার চেষ্টা করেছেন যুগে যুগে মনীষীরা মানুষের সঙ্গে কিভাবে মেলামেশা করেছেন। আমরা সব যুগের মহাপুরুষদের জীবনী পাঠ করি। জুলিয়াস সীজার থেকে শুরু করে টমাস এডিসন পর্যন্ত সমস্ত বিখ্যাত নেতাদের জীবনীই আমরা পড়ে ফেলি। আমার মনে পড়ছে আমরা শুধু থিয়োডোর রুজভেল্টেরই প্রায় শ'খানের জীবনী পড়ে ছিলাম। আমরা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি যুগ যুগ ধরে মানুষ মানুষকে জয় করতে আর প্রভাব বিস্তার করতে যে কার্যকর ধারণা পোষণ করেছে তার প্রতিটি আবিষ্কার করার কাজে আমরা সময় আর অর্থব্যয়ে কার্পণ্য করবো না। আমি ব্যক্তিগতভাবে নিজে বেশ কিছু মানুষের সাক্ষাৎকার নিই, তাদের মধ্যে অনেকেই বিশ্ববিখ্যাত। তাদের মধ্যে ছিলেন মার্কনী, ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট, ওয়েন ডি. ইয়ং ক্লার্ক, গেবল, মেরী পিকফোর্ড, মার্টিন জনসন। এই সব খ্যাতনামাদের সাক্ষাৎকার নিয়ে আমি জানার চেষ্টা করি মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাঁরা কি কৌশল কাজে লাগিয়ে ছিলেন। এই সব মালমশলা দিয়ে আমি ছোট্ট একটা কথিকা তৈরি করলাম। আমি এর নাম দিলাম “প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভ”। এটাকে ছোট্ট বলার কারণ আছে। গোড়ায় এটা ছোট্টই ছিল। তবে বর্তমান এটা বেড়ে উঠে প্রায় দেড় ঘন্টার এক বক্তৃতাতেই পৌঁচেছে। বেশ কয়েক বছর ধরে প্রতিটি শিক্ষাবর্ষে নিউইয়র্কের কার্নেগী ইনস্টিটিউটে প্রাপ্তবয়স্কদের সামনে সে বক্তৃতা আমি দিয়ে গেছি। এই বক্তৃতা দিয়ে আমি তাদের অনুরোধ করেছি সেটা তাদের ব্যবসা আর সামাজিক যোগাযোগে প্রত্যক্ষভাবে কাজে লাগিয়ে পরীক্ষা করতে, তারপর আবার ফিরে এসে আমাদের জানাতে তাদের অভিজ্ঞতা আর ফললাভ কেনম হলো। সত্যিই চমৎকার একটা দায়িত্ব! এই সব স্ত্রী-পুরুষ যারা স্বভাবতই আÍোন্নতির জন্য লালায়িত, তারা নতুন ধরনের কোন গবেষণাগারে কাজ করার প্রেরণায় উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। বয়স্কদের জন্য মানবিক সম্পর্কের এমন গবেষণাগার বলতে এটাই একমেবাদ্বিতীয়ম্। এমন আর ছিল না। এ বইটি ঠিক বই লেখা বলতে যা বোঝায় তেমনভাবে লেখা হয় নি। শিশু যেমন করে বেড়ে ওঠে সেভাবেই এটা বেড়ে ওঠে। এ বই সেই গবেষণাগারে লালিত হয়ে বেড়ে ওঠেÑসে বেড়ে ওঠা হাজার হাজার বয়স্কদের অভিজ্ঞতা পুষ্ট হয়ে। বেশ ক'বছর আগে প্রায় পোস্ট কার্ডের আকারের একখানা কাগজে আমরা কিছু নিয়ম ছাপিয়ে নিয়ে কাজ শুরু করি। পরের বছর আরও বড় একখানা কার্ড ছাপালাম, তারপর একখানা পত্রিকা, তারপর এলো পরপর কতকগুলো ছোট বই। এদের প্রত্যেকটাই আকারে আর উদ্দেশ্যে প্রসারিত। আর এখন পনেরো বছরের অভিজ্ঞতা এবং গবেষণার ফলশ্রুতিতে এসেছে এই বইটি। এ বইতে যে সব নিয়ম আমরা লিপিবদ্ধ করেছি তা শুধু তত্ত্ব বা অনুমান নয়। যতই অবিশ্বাস্য মনে হোক আমি দেখেছি এই নীতি কাজে লাগিয়ে বহু মানুষের জীবনে সত্যিই বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। একটা উদাহরণ দিচ্ছি : গত বছর এই পাঠ গ্রহণ করতে আসেন এমন একজন যাঁর প্রতিষ্ঠানে কর্মীর সংখ্যা ৩১৪ জন। বেশ কবছর যাবৎ তিনি তাঁর কর্মীদের যথেচ্ছভাবে গালিগালাজ আর সমালোচনাই করে এসেছেন। সহৃদয় ভঙ্গি, কাজে প্রশংসা বা উৎসাহ দান তার মুখে কখনও কেউ শোনেনি। এ বইতে যে নীতির কথা আছে সেগুলো পড়ার পর ওই নিয়োগকর্তাটির জীবন দর্শন অদ্ভুতভাবে পাল্টে গেল। তাঁর প্রতিষ্ঠানে আজ জন্ম নিয়েছে এক নতুন উদ্দীপনা, নতুন প্রেরণা, নতুন নিষ্ঠা আর সহযোগিতার আদর্শ। তিনশ চৌদ্দজন শত্রু তিনশ চৌদ্দজন বন্ধুতেই আজ বদলে গেছে। তিনি স্বয়ং একবার ক্লাসের সামনে বেশ গর্বভরে বলেছিলেন : ‘আমার প্রতিষ্ঠানে যখন হেঁটে ঢুকতাম কেউ অভ্যর্থনা জানাতো না বরং আমাকে আসতে দেখে আমার কর্মচারীরা অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিতো। কিন্তু আজ তারা সবাই আমার বন্ধু, এমন কি আমার দারোয়ানও আমায় নাম ধরে ডাকে।' এই নিয়োগ কর্তাটির ব্যবসাতে আজ প্রচুর লাভ, তার অবসরও প্রচুর, আর সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো তিনি তাঁর ব্যবসাতে আর পারিবারিক জীবনে অঢেল সুখ লাভ করেছেন। অসংখ্য সেলসম্যান এই নিয়ম কাজে লাগিয়ে তাদের বিক্রির মাত্রা দারুণ বাড়াতে পেরেছেন। অনেকেই আবার খুঁজে পেয়েছেন জীবিকার নতুন দিগন্ত, নতুন পথ, যে পথ তাঁরা আগে বৃথাই হাতড়ে ঘুরেছেন। কোন প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারেরাও তাঁদের ক্ষমতা বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন। বাড়াতে পেরেছেন তাঁদের আয়। একজন কর্ণধার গতবছর জানিয়েছিলেন তাঁর মাহিনা বছরে পাঁচ হাজারের মত বেড়ে গেছে বিশেষ করে এই বইয়ে লিখিত সত্যগুলো তিনি কাজে লাগান বলেই। আর একজন, ফিলাডেলফিয়া গ্যাস ওয়ার্কস কোম্পানীর এক কর্ণধার, তাঁর কিছুটা ঔদ্ধত্যপূর্ণ কর্মীদের সঠিকভাবে পরিচালনার অযোগ্যতার জন্য প্রায় পদাবনতির মুখোমুখি হন। এই শিক্ষা গ্রহণের ফলে তাঁকে যে পঁয়ষট্টি বছর বয়সে পদাবনতি থেকেই রক্ষা করেছিল তাই নয়, বরং পদোন্নতির সঙ্গে বাড়তি মাইনের সুযোগও এনে দিয়েছিল। বেশ কয়েকবার পাঠক্রম শেষে কোন কোন সম্বর্ধনায় শিক্ষাগ্রহণকারী স্বামীদের স্ত্রীরা উপস্থিত হয়ে বলেছেন যে তাঁদের স্বামীরা এই শিক্ষা গ্রহণ করার ফলে তাঁদের সংসারে সুখ শান্তি বেড়েছে। বহুলোক এই শিক্ষা নিয়ে যে নতুন ফল লাভ করেন তাতে তাঁরা প্রায়ই খুব আশ্চর্য হয়ে যান। সবটাই যেন যাদুবিদ্যার মত। মাঝে মাঝে উৎসাহের আতিশয্যে তাঁরা আবার রবিবারেও আমাকে বাড়িতে টেলিফোন করেছেন, কারণ আটচল্লিশ ঘন্টা অপেক্ষা করে আবার বক্তৃতা শুরুর সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে তাদের সাফল্যের কথা জানানোর ধৈর্য রাখতে পারেন নি। একজন আবার গত বছর এই নিয়মের উপর কোন আলোচনা শুনে এতই বিচলিত হয়ে পড়েন যে ক্লাসে বসেই অন্যান্য সকলের সঙ্গে গভীর রাত পর্যন্ত আলোচনা করে চলেন। রাত প্রায় তিনটের সময় বাকিরা সবাই বাড়ি ফিরে গেলেন, কিন্তু তিনি তাঁর নিজের কৃত ভুল বুঝতে পেরে আর সামনে এক নতুন ঝলমলে ভবিষ্যতের রঙীন হাতছানি দেখে তিনি এতোই উৎসাহিত হয়ে পড়েন যে তিনি ঘুমোতে পারলেন না। ওই রাতে তিনি ঘুমোতে তো পারলেনই না পরের দিন বা রাতেও পারলেন না। তার উপলব্ধি ছিল এমনই। ভদ্রলোক কে হতে পারেন? কোন সাদাসিধে অশিক্ষিত মানুষ হঠাৎ নতুন কিছু তত্ত্ব পেলেই যিনি আঁকড়ে ধরতে পারেন এমন কেউ? না, তা ননÑএ রকম কিছু মোটেই নয়? তিনি বেশ মার্জিত রুচির রাশভারি প্রকৃতির এক শিল্পের ব্যবসায়ী, শহরের নামজাদা মানুষ তিনি, দুটো বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের øাতক আর তিনটে ভাষায় অনর্গল কথা বলতেও পারেন। এই পরিচ্ছেদ লেখার সময় এক প্রাচীনপন্থী অভিজাত জার্মান ভদ্রলোকের কাছ থেকে একখানা চিঠি পাই। ভদ্রলোকের পূর্বপুরুষরা প্রায় সকলেই বংশানুক্রমে হোহেনজোলার্নদের হয়ে সামরিক বাহিনীতে কাজ করেছেন। এক আন্ত-আটলান্টিক যাত্রীবাহী স্টীমার থেকে লেখা তাঁর চিঠিতে তিনি এই নিয়ম সম্বন্ধে যা লিখেছিলেন তাতে যেন ধর্মীয় শ্রদ্ধার স্পর্শ লেগে ছিল। আর একজন, নিউইয়র্কের এক বিশ্বদ্যিালয়ের øাতক। সামাজিক স্তরে যাঁর নাম বেশ উঁচুতেই। ভদ্রলোক বেশ ধনী আর মস্ত এক কার্পেট তৈরির কারখানার মালিক। তিনি জানিয়েছিলেন এই ধরণের পদ্ধতির মধ্য দিয়ে চৌদ্দ সপ্তাহে জনগণের উপর প্রভাব বিস্তারের কৌশল তাঁর চার বছরের কলেজ জীবনের শিক্ষার চেয়ে এটা অনেক বেশি শিখতে পেরেছেন। এটা কি অসম্ভব? হাস্যকর? না অকল্পনীয়? আপনি অবশ্যই যে কোন রকম বিশেষণ যোগ করেই এ বক্তব্য উড়িয়ে দিতে পারেন। আমি শুধু কোন রকম মন্তব্য ছাড়াই একজন রক্ষণশীল আর অত্যন্ত সফল হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের øাতকের বক্তব্যই উল্লেখ করছি মাত্র। ভদ্রলোক তাঁর এই বক্তব্য রেখেছিলেন ১৯৩৩ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারী কোন সন্ধ্যায় নিউইয়র্কের ইয়েল ক্লাবে প্রায় ছ'শ শ্রোতার সামনে। আমাদের যা হওয়া উচিত তার সঙ্গে তুলনা করলে হাভার্ডের বিখ্যাত অধ্যাপক উইলিয়াম জেমস একবার বলেন, ‘আমরা আসলে অর্ধ জাগরিত। আমরা শুধু আমাদের শারীরিক আর মানসিক ক্ষমতার একটা ক্ষুদ্র অংশই কাজে লাগাচ্ছি। আরও ব্যাখ্যা করে বললে বলতে হয় যে কোন একজন মানুষ তার ক্ষমতার তুলনায় ঢের অক্ষমতা নিয়েই জীবন কাটায়। সে তার মধ্যে জমে থাকা বহু বিচিত্র নানা ধরণের শক্তি স্বভাবতই কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়।' যে শক্তি আপনি স্বভাবতই কাজে লাগাতে ব্যর্থ সেই ঘুমন্ত আর অব্যবহৃত মূলধন আবিষ্কার করে তাকে উন্নত করে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যেই এই বইয়ের প্রস্তাবনা। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডঃ জন জি, হিবেন একবার বলেছিলেন, ‘শিক্ষা হলো জীবনের নানা অবস্থার মোকাবিলা করার যোগ্যতা অর্জন।' এই বইয়ের প্রথম তিনটি পরিচ্ছেদ পাঠ করার পরেও যদি আপনি জীবনের নানা অবস্থার মোকাবিলা করার কাজে কিছুটা অভিজ্ঞতা না সঞ্চয় করে থাকেন তাহলে অন্ততঃ আপনার ক্ষেত্রে ধরে নেবো এ বই লেখা ব্যর্থ। যেহেতু হাবার্ট স্পেন্সার বলেছিলেন, ‘শিক্ষার যথার্থ উদ্দেশ্য হলো তাকে কাজে লাগানো, শুধু জ্ঞান আহরণ নয়।' আর এ বই হল কাজে লাগানোরই বই। এই ভূমিকা অন্যান্য সবরকম ভূমিকার মতোই একটু বেশি দীর্ঘ হয়ে গেল। অতএব এখানেই থামা যাক। এখন আসুন, সরাসরি কাজের কথায় আসি। আর দেরি না করে প্রথম পরিচ্ছেদ থেকেই পড়তে আরম্ভ করুন।
ডেল ব্রাকেনরিডজ কার্নেগী, এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে ২৪ নভেম্বর, ১৮৮৮ সালে জন্ম নেওয়া এই আমেরিকান লেখক তাঁর আত্ম-উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ও বইয়ের পাতায় আজও বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় এক নাম। সেলফ-ইম্প্রুভমেন্ট, সেলসম্যানশিপ, করপোরেট ট্রেনিং, পাবলিক স্পিকিং, ও ইন্টার পার্সোনাল স্কিল এর মতো দারুণ সব প্রশিক্ষণের উদ্ভাবন ও এসব বিষয়ে লেখা ডেল কার্নেগী এর বই সমূহ আশার আলো দেখিয়েছে অসংখ্য হতাশাচ্ছন্ন মানুষকে। মিসৌরিতে দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়ার দরূণ বালক বয়স থেকেই কাজ করেছেন ক্ষেতখামারে। এর মাঝেও ওয়ারেন্সবার্গের সেন্ট্রাল মিশৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন। কলেজ শেষে জীবিকার তাগিদে বেকন, সাবান এবং লার্ড (শূকরের চর্বি মিশ্রিত করা) তৈরির কাজও করতে হয় আর্মর অ্যান্ড কোম্পানির জন্য। ফার্মের প্রধান হিসেবে অনেক সাফল্য লাভ ও ৫০০ ইউএস ডলার সঞ্চয়ের পর ১৯১১ সালে বহুদিনের লালিত স্বপ্ন অধ্যাপক হওয়ার জন্য বিক্রয় সেবার কাজটি ত্যাগ করেন তিনি। কিছু ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা ঝুলিতে নিয়ে যখন ওয়াইএমসিএ- এর ১২৫ নম্বরে বাস করতে শুরু করেন, তখনই পাবলিক স্পিকিং এর ধারণাটি মাথায় খেলা করে কার্নেগীর। সেই সময় মোট লভ্যাংশের ৮০% শতাংশের বিনিময়ে ওয়াইএমসিএ এর পরিচালকের কাছে শিক্ষা প্রদানের আগ্রহ প্রকাশ করেন। এভাবেই ১৯১২ সাল থেকে কার্নেগী কোর্সের যাত্রা শুরু হয়। পুরো আমেরিকাবাসীর কাছে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির পথ হয়ে উঠে তার পদ্ধতি। ডেল কার্নেগী এর বই সমগ্র এর মধ্যে ‘হাউ টু উইন ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স’ বইটিকে তার সেরা অবদান হিসেবে ধরা হয়। প্রথম প্রকাশের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই যার ১৭তম মুদ্রণও প্রকাশ করতে হয়েছিলো। ডেল কার্নেগী এর লেখাগুলো বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। ‘বিক্রয় ও জনসংযোগ প্রতিনিধি হবেন কীভাবে’, ‘বন্ধুত্ব ও সম্পদ লাভের কৌশল’, ‘বড় যদি হতে চাও’, ‘ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও সাফল্যের সহজ পথ’ এমন নানা নামের অনূদিত ডেল কার্নেগী বাংলা বই অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে বাংলাভাষী পাঠকদেরও। ডেল কার্নেগী শ্রেষ্ঠ রচনাসমগ্র এর মধ্যে আরও আছে ‘দ্য বায়োগ্রাফি অব আব্রাহাম লিংকন’, ‘ফাইভ মিনিট বায়োগ্রাফিস’ এবং ‘বিশ্বায়নের পটভূমি’। ১ নভেম্বর, ১৯৫৫ সালে আমেরিকান এই অধ্যাপক মৃত্যুবরণ করেন।