একজন ভদ্রলোক দিনের মধ্যে শতবার অজু করতেন। অজুর তার অন্ত ছিল না। নামাজেরও না। বাড়িতে নিজের সম্বন্ধীর পুত্রকে বাল্যকাল থেকে পালন করছেন। নিজের একটি মেয়ে আছে, তারই সাথে বিয়ে দেবেন–এ রকম পাকাপাকি কথা। ছেলেটি ম্যাট্টিক পাস করে কলেজে গেল। তখনও সবাই ভাবছিল, বোধ হয় দু-এক বছরেই ভদ্রলোক কথা পালন করবেন। এর মধ্যে তার ভ্রাতার ছেলেরা বি, এ, পাস করেছে। একদিন তিনি, তারই একজনার সঙ্গে মেয়েটিকে বিয়ে দিলেন। ইনি শতবার নামাজ পড়লেও ধর্মরক্ষা করেছিলেন কি? মুসলমান সমাজে ধর্ম সম্বন্ধে একটা মিথ্যা বিশ্বাস ভূতের মতো পেয়ে বসেছে–এ বিশ্বাস ভাঙ্গা তার জীবনে হয়তো ঘটবে না। জীবনের কদর্যতা সম্বন্ধে সে সচেতন নয়–নিয়ম পালনই হয়েছে তার ধর্ম। একটি লোকের বেতন মাত্র পঁচিশ টাকা। এই পঁচিশ টাকা বেতনের চাকরি করে ইনি জমিদারি করেছেন–চার-পাঁচটি ছেলেমেয়েকে উচ্চ শিক্ষা দিয়েছেন। একজনের বা দশজনের সর্বনাশ না করে কেমন করে তিনি উচ্চাসন লাভ করলেন? অথচ এর জীবনে একবারও নামাজ কাজা হয় নি, কথায় কথায় ইনি কোরানের শ্লোক আবৃত্তি করেন। ইসলাম ধর্মের মতো মহৎ শ্রেষ্ঠ ধর্ম জগতে আর নাই, এই কথা বলেন। মুসলমান জাতির ধর্ম, এই জাতির জীবন এবং আত্মার উপর কোনো প্রভাব বিস্তার করে না। নামাজ! নামাজ! নামাজ! আজান শুনলে পুণ্যের জন্য মুসলমানেরা মসজিদ ঘরের দিকে সন্তান সঙ্গপ্রয়াসী গাভীর মতো পুচ্ছ তুলে দৌড় দেন। মুসলমান জাতির এই ভুল কঠিন আঘাতে ভাঙ্গতে হবে। ধর্ম অর্থ পাপ বর্জনের সাধনা। মিথ্যার সঙ্গে আত্মার সংগ্রাম। প্রার্থনায় এই কাজের সহায়তা হবে–এই জন্য ইসলাম ধর্মে প্রার্থনার ব্যবস্থা। আমি মুসলমান জাতিকে সাবধান করছি–যদি তারা শুধু রোজা-নামাজকেই ধর্ম মনে করে বসে থাকেন, তবে তারা পরকালে কোনোমতে মুক্তি পাবেন না। আমার আত্মীয় শ্রেণীর কোনো কোনো অতি গু-া শ্রেণীর লোক যারা চির-জীবন বেশ্যালয়ে কাটিয়েছেন, তারা বুড়োকালে শক্তিহীন হয়ে শুধু রোজা নামাজ শুরু করে আমাকে ঘৃণায় বলে থাকেন, “তুমি ঘোর দুরাচার লোক। তুমি রোজা-নামাজ অস্বীকার কর? তুমি কাফের?” আমি যে কি বলতে চাচ্ছি সে কথা এইসব বুড়ো মূর্খরা মোটেই বুঝতে চায় না। ঈশ্বরের সঙ্গে প্রেমের বিনিময় এবং গভীর আত্মীক সংযোগ এইসব হতভাগ্য নামাজি দৃর্বত্তেরা শত জীবনেও লাভ করতে পারবে না। কারণ বুড়োকালে তারা কাছাখোলা মুসল্লী হয়েছে, তবু তারা চৌর্য, প্রতারণা, মিথ্যা ও মন্দ জীবন ত্যাগ করতে পারে নি। ধিক এইসব নামাজি শয়তানদিগকে! যদি ইংরাজের আমল না হতো, তা হলে নিশ্চয় অসহিষ্ণু হয়ে এরা আমাকে এতদিন প্রকাশ্যে হত্যা করে ফেলতো। যদিও এ অবস্থায় গোপনে সে প্রচেষ্টা কতিপয় লোকের মধ্যে হয়েছিল। যে মানুষ বা যে জাতির জীবনে ন্যায় ও সত্যের সমাদর নাই–যারা জীবনে ন্যায়বান ও সত্যময় হওয়াকে ধর্ম মনে করেন না–যারা জীবনে মিথ্যা কাজ ও অন্যায় কথা বলতে ভীত হয় না–এতে অধর্ম হয়, এই কথা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে না, বাইরে নিয়ম পালন, ক্রিয়াকলাপ, রোজা-নামাজ এবং পুজাকেই ধর্ম মনে করে, তাদেরকে অপবিত্র শার্দুল জ্ঞানে বর্জন কর। এরা ধর্মের কিছুই জানে না। এই কথা এক বর্ণও মিথ্যা নয়। জগতে যখন ধর্মের ভ্রান্তি ও বিস্মৃতি আসে, তখন ঈশ্বরের বাক্যপ্রাপ্ত এক একজন বাণী বাহকের আবির্ভাব হয়। এ ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছায় হয় না, সময় ও অবস্থার চাপে কঠিন দুঃখের ভিতর দিয়ে শত বেদনাকে জয় করে একটি মানুষের আবির্ভাব হয়–যে সারা জীবন ঈশ্বরের সত্য বাক্য প্রচার করে। মনুষ্য তাকে প্রথমত অগ্রাহ্য করে। যদি জীবনে মিথ্যা কাজ করতে অধর্ম বোধ না কর, অন্যায় করতে অধর্ম মনে না ভাব-জীবনকে সর্ব অন্যায় হতে রক্ষা করতে আন্তরিক চেষ্টা না কর, তবে রোজা-নামাজ করো না। সে রোজা-নামাজ, পূজা-অর্চনা ছুঁড়ে ফেলে দাও। রোজা-নামাজের অন্তরালে জীবনকে মিথ্যামুক্ত করতে চেষ্টা কর। জেনেশুনে অন্যায় ও মিথ্যা করে সর্বদা মসজিদ ঘরে যেয়ো না–ও মিথ্যা ভ-ামী ঈশ্বর সহ্য করতে পারে না। যে চোর, ঘুষখোর, প্রতারক, পরনিন্দুক, আহম্মক, অশিক্ষিত, পরস্বার্থহারী, বিশ্বাসঘাতকতার আবার রোজা-নামাজ কী? তোমার লম্বা জামা, দীর্ঘ নামাজ এবং লম্বিত শ্মশ্রুতে তুমি কিছুতেই বেহেস্তে যাবে না। রে ঘুষখোর–দুর্মতি, রে হারাম (অবৈধ অন্ন) খোর, বেশ্যা–তোমরা কি জন্য কপালে তিলক কাটলে, তীর্থে যাত্রা করলে? এক ব্যক্তি আপন ভ্রাতার পিতৃ-মাতৃহীন সন্তানের সম্পত্তি আত্মসাৎ করবার লোভ করেছে। যেদিন সে এই পিতৃ-মাতৃহীনের সম্পত্তির কেশাগ্র নষ্ট করতে ইচ্ছা করছে, সেদিন হতে তার জীবনের সমস্ত এবাদত, সমস্ত তীর্থ যাত্রার পুণ্য নষ্ট হয়েছে। রে অন্ধ, মানুষ ঠকাচ্ছ–আল্লাহ্কে কী করে ঠকাবে! জীবনে সুন্দর হও–জীবনকে মিথ্যা হতে রক্ষা কর। হায় বিধর্মীরা তোমরা ঈশ্বরকে ধর্ম রক্ষার নামে এমনভাবে অপমান করলে? হে শুদ্ধাচারী তাপসগণ, হে ঈশ্বর মনোনীতেরা, তোমরা ভ- অধর্মীকারীদের সর্পবৎ ভয় কর এবং তাদের সংশ্রব হতে দূরে থাক। অন্ধকার লোকচক্ষুর অগোচরে নিজেকে পরীক্ষা কর–দিবসে কয়টি মিথ্যা, কয়টি অন্যায় করেছ। তারপর নামাজে বসে সে জন্য অনুশোচনা কর–প্রতিজ্ঞা কর, দ্বিতীয় দিন আর পুনরায় তোমার দ্বারা তেমন অন্যায় হবে না। দোহাই তোমাদের–জীবনে সুন্দর ন্যায়বান এবং সত্যময় হও–আমাকে বিশ্বাস কর। আমি হযরত মহম্মদের (সঃ) প্রতিনিধিরূপে তোমাদের সাবধান করি। আমাকে অসম্মান করো না। পাপ করে করে নিত্যই ক্ষমা প্রার্থনা করবে আর মনে করবে ক্ষমা হয়েছে। কোন্ পাগলে বলেছে, তোমাদের নামাজের পূণ্য আলাদা আর পাপের শাস্তি আলাদা। তোমরা মনে কর খোদার হাতে বণিকদের খাতা আছে–যেখানে প্রত্যেক মানুষের হিসাব জমা-খরচ লেখা হবে! ওরে পাগল। জগতের আবর্জনা! তোমাদের নামাজে পুণ্য হয়, কে বলেছে? ও নামাজে এক রতি পুণ্য নাই। নামাজ অর্থ সালাত। সালাত অর্থ প্রার্থনা। প্রার্থনা অর্থ খোদার কাছে পাপের অনুশোচনা, কাঁদাকাটা করা। তুমি যা চাও, তাই পাও কিনা,–সেই কথা ভাব। প্রার্থনা করলে, নামাজ পড়লে ঝুড়ি ঝুড়ি সোয়াব হবে অজ্ঞানদের মাঝে এ বক্তৃতা দেওয়া চলে–একথা কি সজ্ঞান মানুষকে বলা যায়? তোমার সম্মুখে পথ দুইটি–একটি বিনাশের পথ, আর একটি (জীবনের এহসান দেয়) মুক্তির। একদিকে ঈশ্বর, অন্য দিকে শয়তান। একদিকে নূর, অন্যদিকে জুলমাত বা অন্ধকার। প্রতিদিন ধীরে ধীরে চেষ্টা করে জীবনের পথে ঈশ্বরের দিকে অগ্রসর হতে হবে, দিন দিন সাধনা, অনুশোচনা, চিন্তা, অনে¦ষণ ও প্রার্থনা দ্বারা ঈশ্বরের পথে অগ্রসর হবে অথবা দিন দিন অবহেলা, পাপ, মন্দতার-পতন ও বিনাশের পথে ধাবিত হবে। দুই দিকেই অগ্রগতি কী করে হবে? পাপও করবে আলাদা, পূণ্যও করবে আলাদা–সে কি হয়! সত্যের জন্য–ন্যায়ের জন্য দুঃখ সহ্য কর। ইহাই এবাদত। ইহারই নাম ঈশ্বর উপাসনা। ওষ্ঠের আবৃত্তিতে কি ঈশ্বর–অর্চনা হয়?
মোহাম্মদ লুৎফর রহমান তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত যশোর জেলার মাগুরা মহাকুমার (বর্তমান মাগুরা জেলা) পরনান্দুয়ালী গ্রামে ১৮৮৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার মাতা শামসুন নাহার এবং পিতা সরদার মইনউদ্দিন আহমদ, যিনি একজন স্টেশন মাস্টার ছিলেন। এই দম্পতীর চার পুত্র ও এক কন্যার মধ্যে মোহাম্মদ লুৎফর রহমান একজন। তার পৈত্রিক নিবাস ছিল তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরা মহাকুমার হাজীপুর গ্রামে। লুত্ফর রহমানের পিতা ছিলেন এফ.এ পাস। ইংরেজি ভাষা ও ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি তার পিতার অনুরাগ ছিল। সম্ভবত একারণেই পিতার অনুরাগ লুৎফর রহমানের মাঝে প্রতিভাস হয়েছিল। নারী সমাজের উন্নতির জন্য নারীতীর্থ নামে একটি সেবা প্রতিষ্ঠান গঠন এবং নারীশক্তি নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন তিনি এবং একজন চিন্তাশীল ও যুক্তিবাদী প্রাবন্ধিক হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। তার প্রবন্ধ সহজবোধ্য এবং ভাবগম্ভীর। মহান জীবনের লক্ষ্য সাহিত্যের মাধ্যমে মহান চিন্তাচেতনার প্রতি আকৃষ্ট হতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন তিনি। গভীর জীবনবোধ, মানবিক মূল্যবোধ, উচ্চ জীবন, সত্য জীবন, মানব জীবন, সূহ্ম বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি তার রচনার প্রসাদগুণ। প্রবন্ধ ছাড়াও তিনি কবিতা, উপন্যাস ও শিশুতোষ সাহিত্য রচনা করেছেন। এফ.এ অধ্যয়নকালীন সময়ে লুৎফর রহমান তার নিজ গ্রাম হাজীপুরের 'আয়েশা খাতুন' নামে এক মহিলা সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আয়শা খাতুনের পিতা মোহাম্মদ বদরউদ্দীন এ সময়ে মুন্সীগঞ্জ রেলওয়ের বুকিং ক্লার্ক ছিলেন। লুৎফর রহমানের সাহিত্য সাধনা শুরু হয়েছিল মূলত কবিতা রচনার মাধ্যমে। ১৯১৫ সালে চল্লিশটি কবিতা নিয়ে তার প্রথম এবং একমাত্র কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ প্রকাশিত হয়। পরে তিনি বিভিন্ন প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোটগল্প, কথিকা, শিশুতোষ সাহিত্য ইত্যাদি রচনা করেছেন। তার কিছু অনুবাদ কর্মও পাওয়া যায়। চরম দারিদ্রের মুখোমুখি যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে মানবতাবাদী সাহিত্যিক ডাক্তার লুৎফর রহমান ১৯৩৬ সালের ৩১ মার্চ ৪৭ বৎসর বয়সে বিনা চিকিৎসায় নিজ গ্রাম মাগুরার হাজিপুর গ্রামে মৃত্যুবরন করেন