জাতির উত্থান কোনো জাতিকে যদি বলা হয়–তোমরা বড় হও, তোমরা জাগ–তাতে ভালো কাজ হয় মনে হয় না। এক একটা মানুষ নিয়েই এক একটা জাতি। পল্লীর অজ্ঞাত–অবজ্ঞাত এক একটা মানুষের কথা ভাবতে হবে। মানুষকে শক্তিশালী, বড় ও উন্নত করে তোলার উপায় কী? তাকে যদি শুধু বলি–তুমি জাগো–আর কিছু না তাতে সে জাগবে না। এ উপদেশ বাণীর সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত আছে। এইটে ভালো করে বোঝা চাই। আবার বলি–কোনো জাতিকে যদি বাহির হতে বলি–বড় হও তাতে কাজ হবে না। মানুষকে এক একটা করেই ভাবতে হবে। একটা লোক জাতির সহানুভূতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে হাজার হাজার টাকা তুরস্কে পাঠিয়েছিলেন। তিনি যখন নগণ্য আর্ত মানুষের বেদনা কাহিনী গাইতে গাইতে ভিক্ষার ঝুলি স্কন্ধে নিয়ে পথে বের হতেন তখন প্রত্যেক মানুষের প্রাণ সহানুভূতি, বেদনা ও করুণায় ভরে উঠত। এই ব্যক্তি কিছুদিন পর তার এক নিরন্ন প্রতিবেশীর সর্বস্ব হরণ করতে দ্বিধাবোধ করেন নাই। মানুষের এই ভাবের জাগরণ ও বেদনা-বোধের বেশি মূল্য আছে বলে মনে হয় না। কোনো জাতির যখন পতন আরম্ভ হয়, তখন দেশসেবক যে কেউ থাকে না, তা নয়। স্বাধীনতার মমতায় কেউ প্রাণ দেয় না, তা বলি না–যারা দেয় তাদের মন ভিতরে ভিতরে অন্ধ হতে থাকে। জাতিকে খাঁটি রকমে বড় ও ত্যাগী করতে হলে সমাজের প্রত্যেক মানুষকে বড় ও ত্যাগী করতে হবে। কী উপায়ে? দেশের মানুষের ভিতরে আত্মবোধ দেবার উপায় কী? প্রত্যেক মানুষ শক্তিশালী–উন্নতহৃদয়–প্রেমভাবাপন্ন–সত্য ও ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধাবান, অন্যায় ও মিথ্যার প্রতি বিতৃষ্ণা হবে কেমন করে? জাতির প্রত্যেক বা অধিকাংশ মানুষ এইভাবে উন্নত না হলে জাতি বড় হবে না।
মোহাম্মদ লুৎফর রহমান তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত যশোর জেলার মাগুরা মহাকুমার (বর্তমান মাগুরা জেলা) পরনান্দুয়ালী গ্রামে ১৮৮৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার মাতা শামসুন নাহার এবং পিতা সরদার মইনউদ্দিন আহমদ, যিনি একজন স্টেশন মাস্টার ছিলেন। এই দম্পতীর চার পুত্র ও এক কন্যার মধ্যে মোহাম্মদ লুৎফর রহমান একজন। তার পৈত্রিক নিবাস ছিল তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরা মহাকুমার হাজীপুর গ্রামে। লুত্ফর রহমানের পিতা ছিলেন এফ.এ পাস। ইংরেজি ভাষা ও ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি তার পিতার অনুরাগ ছিল। সম্ভবত একারণেই পিতার অনুরাগ লুৎফর রহমানের মাঝে প্রতিভাস হয়েছিল। নারী সমাজের উন্নতির জন্য নারীতীর্থ নামে একটি সেবা প্রতিষ্ঠান গঠন এবং নারীশক্তি নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন তিনি এবং একজন চিন্তাশীল ও যুক্তিবাদী প্রাবন্ধিক হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। তার প্রবন্ধ সহজবোধ্য এবং ভাবগম্ভীর। মহান জীবনের লক্ষ্য সাহিত্যের মাধ্যমে মহান চিন্তাচেতনার প্রতি আকৃষ্ট হতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন তিনি। গভীর জীবনবোধ, মানবিক মূল্যবোধ, উচ্চ জীবন, সত্য জীবন, মানব জীবন, সূহ্ম বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি তার রচনার প্রসাদগুণ। প্রবন্ধ ছাড়াও তিনি কবিতা, উপন্যাস ও শিশুতোষ সাহিত্য রচনা করেছেন। এফ.এ অধ্যয়নকালীন সময়ে লুৎফর রহমান তার নিজ গ্রাম হাজীপুরের 'আয়েশা খাতুন' নামে এক মহিলা সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আয়শা খাতুনের পিতা মোহাম্মদ বদরউদ্দীন এ সময়ে মুন্সীগঞ্জ রেলওয়ের বুকিং ক্লার্ক ছিলেন। লুৎফর রহমানের সাহিত্য সাধনা শুরু হয়েছিল মূলত কবিতা রচনার মাধ্যমে। ১৯১৫ সালে চল্লিশটি কবিতা নিয়ে তার প্রথম এবং একমাত্র কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ প্রকাশিত হয়। পরে তিনি বিভিন্ন প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোটগল্প, কথিকা, শিশুতোষ সাহিত্য ইত্যাদি রচনা করেছেন। তার কিছু অনুবাদ কর্মও পাওয়া যায়। চরম দারিদ্রের মুখোমুখি যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে মানবতাবাদী সাহিত্যিক ডাক্তার লুৎফর রহমান ১৯৩৬ সালের ৩১ মার্চ ৪৭ বৎসর বয়সে বিনা চিকিৎসায় নিজ গ্রাম মাগুরার হাজিপুর গ্রামে মৃত্যুবরন করেন