উম্মাহর শক্তি-সামর্থ্য, বিশুদ্ধতা, জ্ঞান ও অনুপ্রেরণার মহান দুই উৎস কুরআন ও সুন্নাহ্ সম্পর্কে যথেষ্ট গবেষণা করা হয়নি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজস্ব চৌহদ্দি পেরিয়ে অথবা তাদের বহুমুখী বিষয়ের শুধু দুইএকটি শাখা-প্রশাখায় অতিরিক্ত আলোচনা-পর্যালোচনা করে এ শাশ্বত উৎসের ব্যাপক সম্ভাবনার প্রতি চরম অবিচার করা হয়েছে। এভাবে উম্মাহ্ তথা সমগ্র বিশ্বকে তার ব্যাপক উপকারিতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। যেহেতু উম্মাহ এখন তার হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস ও সভ্যতার পুনরুজ্জীবনে তার নিজস্ব সমস্যা এবং সুপ্ত ক্ষমতা ও নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষায় ক্রমবর্ধমানভাবে সচেতন, তাই বিষয়টি এখন অধিকতর প্রাসঙ্গিক ও জরুরি। এই দুই উৎসের পুনঃপরিদর্শন এখন আর অতিমাত্রায় পাণ্ডিত্যপূর্ণ অতীত স্মৃতি রোমন্থন বা পলায়নী মনোবৃত্তির পরিচায়ক নয় বরং এ হচ্ছে আবিষ্কারের পথে এক মহাযাত্রা- যাতে আছে অজস্র পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি। আর আবিষ্কারের সকল মহাযাত্রার ন্যায় এ ক্ষেত্রেও আসতে পারে বহুবিধ বাধা ও সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতা। তবে দৃঢ় ইচ্ছায় বলীয়ান হয়ে এ ক্ষেত্রে অগ্রসর হলে এবং মহাপথনির্দেশক এবং সকল পরিব্রাজকের আলোকবর্তিকার রহমত ও করুণার এ অভিযাত্রা থেকে খালি হাতে, বিফল মনোরথে ফিরে আসার কোনো অবকাশ থাকবে না। বস্তুত এই পুরস্কার পরিমাপযোগ্য নয়। মানুষের সুপ্তশক্তি ও আল্লাহর পরিকল্পনার উন্নততর উপলব্ধি; ভারসাম্যপূর্ণ, সক্রিয় ও উদ্দেশ্যমূলক জীবনের পুনরুজ্জীবন, মর্যাদা, শান্তি ও সম্প্রীতির পুনরুদ্ধার শুধু উম্মাহ্র নয় বরং সমগ্র বিশ্ব ভ্রান্ত আদর্শ ও ধারণায় বিভ্রান্ত হয়েছে বারবার। মূলত, কুরআন ও সুন্নাহ্ উজ্জ্বলতর অধ্যায়সমূহে অতীতের অভিযাত্রার (গবেষণা ও পর্যালোচনা) মাধ্যমে সামাজিক ও ঐতিহাসিক পরিবর্তনের গতিশীলতা এবং পৃথিবীতে মানুষের ভূমিকা সম্পর্কে অধিকতর সচেতনতা সৃষ্টি করবে এবং বর্তমান কালের চাহিদা ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মুসলমানদের সামর্থ্যকে শাণিত ও প্রাণবন্ত করে তুলবে। এ ক্ষুরধার অভিযাত্রায় সংশ্লিষ্ট মানবিক ও আপেক্ষিক দিকগুলো শুধু আমাদের মুসলমান ভাইদের মানবজাতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর করবে না বরং আমাদের আরো সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে সর্বোচ্চ সফল জীবন ও প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দু সৃষ্টিকর্তার কাছে নিয়ে যাবে । এই গ্রন্থের প্রথম নিবন্ধে ড. ত্বাহা জাবির আল-আলওয়ানী আল্লাহ তায়ালার নাযিলকৃত ও সুরক্ষিত কুরআনকে জ্ঞানের উৎস হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। এটা এমন এক উৎস -যা থেকে যথাযথ মাধ্যমে উপকার পাওয়া যেতে পারে। ড. আলওয়ানী যুক্তি দেখিয়েছেন যে, কুরআন অধ্যয়নের দুটি পর্যায় রয়েছে। প্রথম হচ্ছে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ চর্চা সম্পর্কিত আর দ্বিতীয় হচ্ছে খলিফা হিসেবে মানুষকে পৃথিবীতে ইতিবাচক কর্ম সম্পাদনের লক্ষ্যে বিশ্বজাহান অধ্যয়নের আহ্বান জানানো সংক্রান্ত। এই উভয় অধ্যয়ন একত্রে সম্পাদন এবং তাদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখাই হচ্ছে এই পৃথিবী ও পরজগতের কল্যাণ লাভের পূর্বশর্ত । পূর্বেকার প্রজন্মসমূহ কুরআন ও পরকালের বিভিন্ন দিকের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন এবং নাযিলকৃত ওহিকে ফিকাহ ও আইন কানুনের উৎস হিসেবে গণ্য করেছেন। কুরআনের এ ধরনের সীমিত অধ্যয়ন বহুকাল ধরে স্থান ও কালের প্রেক্ষাপটে তার উপযোগিতা নিরূপণের উৎসাহ-উদ্দীপনাকে দমিয়ে রেখেছে। এ নিবন্ধে ড. আলওয়ানী এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন যাতে কুরআনকে সঠিকভাবে অনুধাবন করা যায়। অনুরূপভাবে ড. আল-আলওয়ানীর দ্বিতীয় নিবন্ধ সুন্নাহর সুষ্ঠু অধ্যয়ন থেকে একদিকে যেমন হযরত মুহাম্মদের সা. নবুয়তের লক্ষ্য অনুধাবনে সহায়ক হবে, অপরদিকে তেমনি আমাদের কালের ও স্থানের বাস্তব চাহিদা অনুসারে সুন্নাহ্ চেতনার যুক্তিসঙ্গত বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। ড. ইমাদ আল দীন খলিল তার নিবন্ধে কুরআন ও বিজ্ঞানের মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়ে বলেছেন, কুরআন বিজ্ঞানের কোনো পাঠ্যপুস্তক নয়, তবে এতে সরাসরি বৈজ্ঞানিক তথ্য বা নির্দেশনার আকারে বিজ্ঞানবিষয়ক উপাত্ত (Data) রয়েছে। তাঁর মতে এসব বৈজ্ঞানিক উপাত্ত কাজে লাগানোর জন্য কুরআন একটি নমনীয় ও সার্বিক পদ্ধতি (বিধি) পেশ করেছে—যে পদ্ধতি স্থান ও কালের পরিবর্তনের শিকার হবে না এবং প্রত্যেক যুগ ও পরিবেশে কার্যকর থাকবে। সর্বোপরি এই গ্রন্থে দু'জন খ্যাতনামা মুসলিম চিন্তাবিদ ড. আল-আলওয়ানী এবং ড. খলিল কুরআন ও সুন্নাহ্কে নতুনভাবে অধ্যয়নের জন্য ইসলামি কাঠামোর আওতায় এসব উৎসের প্রতি সুষ্ঠু দৃষ্টিভঙ্গির জন্য তাদের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন।
ত্বাহা জাবির আল আলওয়ানী ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে/১৩৫৪ হিজরিতে ইরাকে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীয়া ও আইন কলেজ থেকে ১৯৫৯ খ্রি./১৩৭৮ হিজরিতে অনার্স এবং ১৯৬৮ খ্রি:/১৩৮৮ হিজরিতে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৩ খ্রি./১৩৯২ হিজরিতে উসূল-ই-ফিকহ এর উপর ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। পেশাগত জীবনে তিনি ১৯৭৫ খ্রি./১৩৯৫ হি. থেকে ১৯৮৫ খ্রি./১৪০৫ হি. পর্যন্ত সৌদী আরবের ইমাম মুহাম্মদ ইবন সউদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিকহ ও উসূল-ই-ফিকহ্ এর প্রফেসর ছিলেন। এছাড়া তিনি ১৯৮৭ খ্রি./১৪০৭ হি. OIC'র ইসলামিক ফিকহ একাডেমীর সদস্য ছিলেন। ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স সংক্রান্ত তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলী হলো- ইমাম ফখরুদ্দীন রাজীর আল মাহসুর ফি ইল্ম উসূল আল ফিকহ্ [উসূল-ই-ফিক সংক্ষিপ্ত সার] এর ব্যাখ্যা সংক্রান্ত ৬ খণ্ডের বই, আল ইজতিহাদ ওয়া আল তাকলীদ ফি আল ইসলাম। [ইসলামে আইনগত যুক্তি ও অনুকরণ], হুকুক আল মুত্তাহাম ফি আল ইসলাম [ইসলামে অভিযুক্তের অধিকার], আদব আল ইখতিরাফ ফি আল ইসলাম [ইসলামের মত পার্থকের নীতি] এবং উসূল আর ফিকহ্ আর ইসলামি [ইসলামি আইনশাস্ত্রের উৎস পদ্ধতি], এছাড়াও তিনি বহু গ্রন্থ ও অগণিত প্রবন্ধ লিখেছেন-যা জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।