মেডিকেল এথিক্স বিষয়টি বাংলাদেশে একটি অনালোচিত এবং উপেক্ষিত বিষয়। অথচ কয়েক হাজার বছর পূর্বে মিসরিয় এবং গ্রিক সভ্যতার যুগে চিকিৎসা শাস্ত্রের উন্মেষকালীন সময় থেকেই চিকিৎসা পেশার একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান মেডিকেল এথিক্স। হিপোক্রেটস, গ্যালেন, এরিস্টটল প্রমূখ মনীষী চিকিৎসা পেশাজীবিদের জন্য অনুসরণীয় বেশ কিছু নীতিকথা বলে গিয়েছেন। সপ্তম শতক থেকে শুরু হওয়া ইসলামি রেনেসাঁর যুগে বিভিন্ন আরব মুসলিম বিজ্ঞানীর অবদানে গ্রিক-চৈনিক-ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যা ইসলামের ন্যায়-নীতির আত্মা লাভ করে এক উন্নততর বিজ্ঞানে পরিণত হয়। তৎকালীন মুসলিম চিকিৎসাবিদগণ একাধারে ডাক্তারি শাস্ত্র, অন্যদিকে ইসলামি শরিআহ বিষয়ে পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন, তাঁদের অবদানে ডাক্তারী শাস্ত্র একটি উন্নত প্রযুক্তি সম্পন্ন বিজ্ঞানে পরিণত হয়; একই সাথে ডাক্তাররাও সমাজের নীতিবান এবং শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে পরিগণিত হন। তাঁদের অবদানে মেডিকেল টেকনোলজি এবং এথিক্স দুটোই উচ্চমাপে পৌঁছে। এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিজ্ঞানী আবু আলী আল হুসাইন ইবনে সিনা। তাঁর রচিত মেডিকেল টেক্সট বই ‘কানুন ফিল তিব্ব’ সপ্তদশ শতকের শেষ পর্যন্ত ইউরোপের প্রায় সকল মেডিকেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে চালু ছিল। এ কানুনের একটি বড় অংশ চিকিৎসকের ব্যবহৃত আচরণবিধি বা এথিক্স সংক্রান্ত। মুসলিম সভ্যতার পতনের মুখে ইউরোপে শিল্প-বিপ্লব এর মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। মুসলিম চিকিৎসকগণ চিকিৎসা পেশাকে শুধু আয়ের উৎস হিসেবেই দেখতেন না বরং মানুষের চিকিৎসার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের বাহন হিসেবে দেখতেন। পক্ষান্তরে পুঁজিবাদী সভ্যতার প্রভাবে ডাক্তারী শাস্ত্র সেবা-পেশার পরিবর্তে একটি লাভজনক পেশায় পরিনত হয়। ক্রমান্বয়ে রোগী এবং মানুষের কষ্ট হয়ে ওঠে এ ব্যবসার পুঁজি। ফলে পাশ্চাত্যের মেডিকেল চর্চা যত টেকনোলজিতে অগ্রসর হয় ততই মানবিকতা হারিয়ে ফেলে। বিশ শতকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে এ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিভিন্ন দেশের চিকিৎসা পেশাজীবিদের সংগঠন-এর সহায়তায় তৈরি হয় WMA। তাঁরা চিকিৎসা পেশার নৈতিক মান, ডাক্তারদের দায়িত্ব, দায়বদ্ধতা, অধিকার, আইনি সুরক্ষা, রোগীর অধিকার, সামাজিক দায়িত্ব ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে অনেক সেমিনার, ওয়ার্কশপ করে। যার ভিত্তিতে অসংখ্য প্রকাশনা এবং আইন গড়ে ওঠে। যেহেতু নীতিবোধ বিষয়টি ৮ চিকিৎসায় নৈতিকতা ও দায়বদ্ধতা ভূমিকা ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত সেহেতু ষাটের দশক থেকেই বিভিন্ন ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে মেডিকেল এথিক্স বিষয়টির আলোচনা শুরু হয়। যেমন গর্ভপাত, কৃপাহত্যা ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ধর্মীয় নির্দেশনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ষাটের দশকেই আমেরিকা প্রবাসী প্রখ্যাত মুসলিম মেডিকেল স্কলার প্রফেসর ওমর কাসুলী, আলী মিশাল, শাহিদ আতাহার প্রমুখ ইসলামি মেডিকেল এথিক্স নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। বিষয়টি দু’ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, ইসলামি মেডিকেল এথিক্স পাশ্চাত্যের মেডিকেল এথিক্স-এর চাইতেও মানুষের অধিকারের প্রতি বেশি নিবেদিত; এটি চিকিৎসা পেশাকে একটি ইবাদত (হক্কুল ইবাদ/ফরজে কিফায়া) হিসেবে বর্ণনা করে; দ্বিতীয়ত, মুসলিম চিকিৎসক এবং রোগীরাও যে কোনো এথিকোলিগাল ইস্যুতে ইসলামি সমাধান পেতে বেশি আগ্রহী। উল্লিখিত মনীষীদের চেষ্টায় Islamic Medical Association of North America গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশের সংগঠনগুলো কেন্দ্রীয় সংগঠন হিসেবে FIMA (Federation of Islamic Medical Association) গড়ে ওঠে। FIMA তার শাখাসমূহের মাধ্যমে ইসলামি মেডিকেল এথিক্স এর চর্চাকে এগিয়ে নেয়।
আবুল ফজল মোহসিন ইব্রাহিম দক্ষিন আফ্রিকায় জন্মগ্রহণকারী এই স্কলার যুক্তরাষ্ট্রের টেম্পল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ ডি ডিগ্রি লাভ করেন । এর আগে তিনি করাচী Aleemiyah Institute of Islamic Studies থেকে বি.এ.অনার্স এবং মিসরীর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে থিওলজিতে গ্রাজুয়েশন ও মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে তিনি ডারবান এর কুয়াজুলু-নাতলি (Kwazulu-Natal) বিশ্ববদ্যালয় ধর্ম ও থিওলজি বিভাগে প্রফেসর এমিরেটার্স হিসেবে কর্মরত। তাঁর জীবনের একটি বড় অংশ অতিবাহিত হয়েছে সাম্প্রতিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন অগ্রগতির চর্চার নৈতিক সীমারেখা (Ethical Boundary) নির্দেশনায়। তার রচিত কয়েকটি বিশ্বখ্যাত গ্রন্থ: “Islamic Ethics and the Implications of Modern Biomedical Technology: An Analysis of some issues of Reproductive Control, Biotechnical parenting and Abortion (1986)”, “Abortion, Birth Control and, surrogate parenting: An Islamic Perspective".