শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অন্যতম একটি উপন্যাস হলো ‘চরিত্রহীন’।এতে চিত্রিত হয়েছে তৎকালীন বাঙালি সমাজের সাধারণ জীবন-যাপন,প্রেম-বিরহ ও নানাবিধ ঘটনাবলি।উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র উপেন্দ্র বা উপীনদার বাড়িতে একটি আড্ডা দিয়ে শুরু হয় উপন্যাসটির কাহিনী।উপীনদা সাধারণত একটি সৎ,চরিত্রবান ও নিষ্ঠাবান হিসেবেই পরিচিত এবং তার স্ত্রী সুরবালা আগাগোড়াই একজন ধর্মান্ধ মানুষ।উপীনদার খুব কাছের অনুজ ও বন্ধু ‘সতীশ’ অন্যতম একটি চরিত্র।সতীশ দুবার এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে পাশ করতে না পেরে কলকাতার এক হোমিও কলেজে ভর্তি হয় এবং তার বাবা একজন জমিদার।সেখানে মেসে থাকাবস্থায় সাবিত্রী নামক এক বিধদাসীর প্রেমে পড়ে যায়। একসময় তাদের মনোমালিন্যের কারণে সতীশ অন্য বাসায় উঠতে বাধ্য হয়।এবং সতীশের ধারণা তার মদ্যপ বন্ধু বিপিনের পাণি গ্রহণ করে সাবিত্রী।কিন্তু সাবিত্রী তাকে খুবই ভালোবাসতো।এর মধ্যে সুরবালার বোন শচীর সাথে উপীনদার দূরসম্পর্কের আত্মীয় ও তার বাড়িতে আশ্রিত দিবাকরের সাথে বিবাহ ঠিক করে।ইতোমধ্যে সতীশ তার চাকর বিহারীকে নিয়ে হোমিও কলেজ বাদ দিয়ে বাড়ি চলে আসে।উপীনদার আত্মীয় হারানের প্রয়োজনে সতীশকে নিয়ে কলকাতায় রওনা হয় এবং বন্ধু ব্যারিস্টার জৌতিষের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করে।সতীশের সুঠাাম দেহ,গলার সুর ও উপীনদার প্রশংসায় জৌতিষের বোন সরোজিনীর নিকট সে খুবই প্রিয় হয়ে ওঠে এবং পরবর্তীতে তা ভালবাসায় রূপান্তরিত হয়।উপীনদার দুরাত্মীয় দিবাকর হারানের বিধবা স্ত্রীকে নিয়ে আরাকান পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে সরোজিনীর সাথে সতীশের বিয়ে পাকা হয়।কিছুদিনপর দিবাকর,কিরনময়ীসহ সবার উপস্থিতিতেই উপেন্দ্রর প্রয়াণ ঘটে। রচনার কয়েক দশক পার হলেও ‘চরিত্রহীন’ এখনো তার আবেদন হারায়নি।তৎকালীন ভারতীয় উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের এক উজ্জ্বল কাহিনী চিত্রায়িত হয়েছে।এউপন্যাসে দেখানো হয়েছে যে,প্রেম একটি সহজাত বিষয়।কখন কার মাঝে উদিত হবে সেটা বলা মুশকিল।কিন্তু সেটা সমাজের সাধারণ নিয়মকানুনের উর্দ্ধে নয়।সতীশ সাবিত্রীর প্রেমে পড়ে কিন্তু সেটাকে সমাজবহির্ভূত বলা যায় না।তাছাড়াও উপন্যাসটিতে তৎকালীন হিন্দু সমাজের বর্ণপ্রথা জগত্তারিণীর চরিত্রের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে এবং মুসলিম-খ্রিস্টান জাতিকেও একইজ্ঞান করা হয়েছে। ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাসটি তৎকালীন ভারতীয় বাঙালি সমাজেরপ্রেক্ষাপটেই রচিত।খুবই সহজ ভাষায় রচিত উপন্যাসটি শুরু হয়েছে কমেডি বা হাস্যরস দিয়ে এবং শেষ হয়েছে ট্রাজেডির মধ্যে দিয়ে।উপন্যাসটির চরিত্রগুলোও ছিল প্রাণবন্ত।
বাঙালির জীবনের আনন্দ-বেদনাকে সাবলীল স্বচ্ছন্দ ভাষায় যে কথাশিল্পী পরম সহানুভূতি ভরে তুলে ধরেছেন বাংলা সাহিত্যে, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৭৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, হুগলি জেলার ছোট্ট গ্রাম দেবানন্দপুরে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শরৎচন্দ্র। দারিদ্র্যের কারণে তাঁর শৈশবকাল বলতে গেলে মাতুলালয় ভাগলপুরেই কেটেছে। দারিদ্র্যের কারণে ফি দিতে না পেরে বেশ কয়েকবার স্কুল বদলিও করতে হয়েছিলো ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত ও মেধাবী শরৎচন্দ্রের। এন্ট্রান্স পাস করে কলেজে ভর্তি হলেও এফএ পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে না পেরে পরীক্ষায় বসতে পারেননি। দারিদ্র্য যখন শিক্ষাজীবনে অব্যহতি টানলো, তারপরই শুরু হলো আপাত সাধারণ এই মানুষটির বর্ণাঢ্য কর্ম ও সাহিত্যজীবন। এ সময় প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্টের বাড়িতে আয়োজিত সাহিত্যসভায় লেখালেখির অনুপ্রেরণা ফিরে পেলেন যেন আবার। যার ফলশ্রুতিতে বাংলা সাহিত্য পেয়েছিলো বড়দিদি, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা’র মতো কালোত্তীর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর উপন্যাস সমগ্র। কাছাকাছি সময়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প অনুপমার প্রেম, আলো ও ছায়া, হরিচরণ, বোঝা ইত্যাদি রচিত হয়। বনেলী রাজ স্টেটে সেটলমেন্ট অফিসারের সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন এসময়। কিন্তু তারপরই বাবার উপর অভিমান করে সন্ন্যাসদলে যোগ দিয়ে গান ও নাটকে অভিনয়ে মনোনিবেশ করেন। কখনও কলকাতা হাইকোর্টের অনুবাদক, আবার বার্মা রেলওয়ের হিসাব দপ্তরের কেরানি হিসেবেও কাজ করেন শরৎচন্দ্র। রাজনীতিতেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ১৯২১ সালে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে, এবং হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে। এর মাঝে নিরন্তর চলেছে নিজস্ব জীবনবোধ ও অভিজ্ঞতা উৎসারিত সাহিত্যচর্চা। সমষ্টি আকারে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গল্প সমগ্র বিন্দুর ছেলে ও অন্যান্য, শ্রীকান্ত-৪ খন্ড, কাশীনাথ, ছেলেবেলার গল্প ইত্যাদি সময় নিয়ে প্রকাশিত হলেও পেয়েছিলো দারুণ পাঠকপ্রিয়তা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমূহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এবং বিশ্বব্যাপী পাঠকের কাছে হয়েছে সমাদৃত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমগ্র দেবদাস, শ্রীকান্ত, রামের সুমতি, দেনা-পাওনা, বিরাজবৌ ইত্যাদি থেকে বাংলাসহ ভারতীয় নানা ভাষায় নির্মিত হয়েছে অসাধারণ সফল সব চিত্রনাট্য ও চলচ্চিত্র। সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য এই খ্যাতিমান বাংলা সাহিত্যিক কুন্তলীন পুরস্কার, জগত্তারিণী স্বর্ণপদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি লাভ করেন। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।