“কবিতা ও প্রসঙ্গিক ভাবনা” গ্রন্থে দিল মনোয়ারা মনু-সুফিয়া কামাল, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, মেহেরুননেসা , জাহানারা আরজু প্রমুখ খ্যাতিমান মহীয়সী কবিদের জীবন ও কবিতায় বিশেষ অবদানের কথা তুলে ধরেছেন। সেই সাথে এমিলি ডিকিন্সন, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত চক্রবাক কবিতা গ্রন্থের কাব্যবিচার ও বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্য প্রতিভা ও জীবন অন্বেষা ও মৃত্যু চেতনার কিছু অংশ ক্ষুদ্র পরিসরে গ্রন্থকার বিশ্লেষণ করেছেন। সর্ব মোট আটটি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে এই গ্রন্থে। বইটি কলেবরে খুব বেশি বড় না হলেও রচনা শৈলীর গুণে কবিদের বর্ণাঢ্য জীবন ও তাদের কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। এই গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধটি যাঁকে নিয়ে লেখা তিনি বাংলার নারী সমাজের গৌরব সুফিয়া কামাল। বিশ শতকে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নারী, যিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন, এবং বাংলাদেশ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। একই সাথে তিনি এদেশের জাতীয় পর্যায় একজন খ্যতিমান কবি। দিল মনোয়ারা মুন সুফিয়া কামালের সংক্ষিপ্ত জীবন, সংগ্রাম, আন্দোলন ও সৃজনশীলতা একই সুত্রে গেঁথেছেন। কাব্য চর্চার মাধ্যমে সুফিয়া কামাল জীবন বোধ প্রকাশ করেন এবং সমসাময়িক অনেক কবি থেকে চিন্তা, চেতনায় তিনি কিছুটা পৃথক ছিলেন সে বিষয়ে লেখক আলোকপাত করেছেন। সেই সাথে লেখক উল্লেখ করেছেন কবির প্রথম দিকের কবিতার বিষয় ছিল প্রেমের মাধুর্য ও বেদনা, মিলন ও বিরহ, প্রাপ্তি ও তিরোধান ইত্যাদি। পরবর্তী সময়ে সমাজ চেতনা ও সমসাময়িক প্রসঙ্গ উঠে এসেছে সুফিয়া কামালের কবিতায়। একই সাথে সহজিয়া ধারায় কবি দেশাত্ববোধ ও মানবাত্মার মুক্তির বাণী রচনা করেছেন পরম ঔদার্যে । দিল মনোযারা মনু পরম যত্নে আলোচনা করেছেন সুফিয়া কামালে কাব্য প্রতিভা। দ্বিতীয় প্রবন্ধটির শিরোনাম-“সুন্দর ও প্রেম পূজারী : কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা”। ঊনিশ শতকে বঙ্গে সামাজিক জাগরণের মধ্য দিয়ে আধুনিক শিক্ষা প্রসারের প্রভাবে আর্থসামাজিক সূচনা লগ্নে যখন মুসলমান মেয়েদের লেখাপড়া ও সাহিত্য চর্চা নিষিদ্ধ ছিল সেই সময় যে কজন নারী সেই অর্গল ভেঙ্গে কাব্য চর্চা শুরু করেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা। যার কবিতার ছত্রে ছত্রে উঠে এসেছে জীবন ও সংগ্রাম, প্রেম, বিরহ, বাংলার নিসর্গ মাটি ও মানুষ, সমকালীন ঘটনা, সামাজিক ও রাষ্ট্রিয় প্রেক্ষাপট এবং দেশপ্রেম। দিল মনোয়ারা মুন পরম মমতায় মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার কাব্য প্রতিভা ও বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদানের কথা রচনা করেছেন এই প্রবন্ধে। “চেতনার বহ্নিতে : সংগ্রামী কবি মেহেরুননেসা’ এই প্রবন্ধে লেখক কবি মেহেরুননেসার সংগ্রামী জীবনের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। বিত্তহীন পরিবারের একজন হওয়া সত্ত্বেও চিত্তের বৈভবে মেহরেুননেসা তীক্ষ চেতনাবোধ সম্পন্ন কবি হিসেবে এদেশের কাব্যাঙ্গঁনে নিজের আসন প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। মেহেরুননেসা সংসারকে ভালবেসেছেন, দেশকে ভালবেসেছেন। ভালবেসেছেন দেশের মানুষকে। তাঁর কাব্যসৃষ্টিতে উঠে এসেছে বাঙালির সবচেয়ে বড় অর্জন একুশের কথা, ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান, ‘৭০ এর নির্বাচন ও বিজয়, ‘৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা। সংগ্রামী মেহেরুননেসা জীবন বোধে উজ্জ্বল কবি ছিলেন। তাঁর কাব্য প্রতিভা সম্পূর্ণ রুপে প্রস্ফুঠিত হওয়ার পূর্বেই ৭১ সালে ২৭ মার্চ বিহারীদের নির্মম ছুরিঘাতে শহীদ হন। প্রতিকূল পরিবেশে বেড়ে উঠার পরও কবি মেহেরুননেসা জীবনভর সৃজনশীল সাধনায় নিমগ্ন থেকেছেন। এই প্রবন্ধে দিল মনোয়ারা মনু মেহেরুননেসার জীবন সংগ্রামের ইতিবৃত্ত ও তাঁর কাব্য প্রতিভা অপার ভালবাসায় এবং পরম মমতায় তুলে ধরেছেন। পঞ্চাশ ও ষাট দশক থেকে কবিতা লিখে যিনি কবিতার জগতকে আরেক মাত্রায় নিয়ে গেছেন তিনি কবি জাহানারা আরজু। যিনি এক সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে উঠেছেন। কিশোর বয়স থেকেই সাহিত্য জগতের বহু আলোকিত ব্যক্তিত্বের সাহচর্যে ও সান্নিধ্যে এসেছেন। অনুপ্রাণিত হয়েছেন এবং নিজ কবি সত্ত্বাকে বিকাশমান করতে উদ্দীপ্ত হয়েছেন। দিল মনোয়ারা মনু “জীবনবোধে উজ্জ্বল : কবি জাহানারা আরজু” প্রবন্ধে কবির জীবনবোধ, মানবপ্রেম, জাতীয় জীবনে সাহিত্য সংস্কৃতির সাথে কবির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে সাবলীল ভাষায় আলোকপাত করেছেন। “চক্রবাক’ কাব্য বিচার” প্রবন্ধে দিল মনোয়ারা মনু বিদ্রোহী কবি, সাম্যের কবি-নজরুল ইসলামের কবিতার রোমান্টিক কবিসত্তা তুলে ধরেছেন। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতায় প্রকৃতি প্রেম , দেহপ্রেম, মানবপ্রেমের সুখ-দু:খ, আশা-নিরাশা, বিরহ-বেদনার চিত্র লেখক দক্ষতার সাথে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেছেন। “কালজয়ী কবি: এমিলি ডিকিন্সন ” প্রবন্ধে দিল মনোয়ারা মনু কবিকে মার্কিন সাহিত্যের একজন অনন্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। নির্ভৃতচারী এমিলি ডিকিন্সন রোমান্টিক কাব্য চর্চার ক্ষেত্রে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছেন যা সময়কে অতিক্রম করতে পেরেছে। দিল মনোয়ারা মনু নিষ্ঠার সাথে এই প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন। দিল মনোয়ারা মনু “রবীন্দ্র মানসে জীবন অন্বেষা ও মৃত্যু চেতনা” প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথকে উদার মানবতাবাদী কবি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ইউরোপীয় উদার নৈতিক প্রভাব প্রবল ছিল তাই সংকীর্ণ ধর্মান্ধতা সাম্প্রদায়িকতা তাঁর সাহিত্য চর্চায় স্পর্শ করতে পারেনি। সেই সাথে রবীন্দ্রনাথ এক জীবনে মৃত্যুর তীব্র যাতনায় শোকাহত হয়েছেন বারবার সেই পরম দু:খের চিত্র তুলে ধরেছেন এই প্রবন্ধে। রবীন্দ্রনাথ ছেলেবেলায় মা’কে হারিয়েছেন, ২২ বছর বয়সে প্রাণপ্রিয় বৌদি চলে গেলেন, ৪১ বছর বয়সে স্ত্রীকে হারালেন। তারপর একে একে তিন কন্যা ও এক পুত্র হারানোর শোক বহন করেছেন। বিস্ময়ের ব্যাপার তাঁর সৃজনশীল কর্মযজ্ঞ এতটুকু ম্লান হয়নি। তিনি লিখে গেছেন নিরন্তর। দিল মনোয়ারা মনু অত্যন্ত মমতার সাথে উপস্থাপন করেছেন রবীন্ত্রনাথের মৃত্যু চেতনার কথা। এই গ্রন্থের শেষ প্রবন্ধের শিরোনাম“বাংলা সাহিত্যের বিস্ময়: রবীন্দ্র কাব্য প্রতিভা’। দিল মনোয়ারা মনু রবীন্দ্রনাথের বিশাল কাব্যপ্রতিভা সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরেছেন এই প্রবন্ধে। লেখক রবীন্দ্রনাথকে চিহ্নিত করেছেন বাংলা সাহিত্যের অবিনশ^র কারিগর হিসেবে। তিনি আরও লেখেন, বাংলা সাহিত্যের কালসন্ধিতে রবীন্দ্রনাথ নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। জীবনে যা মৌল সত্য এবং মহত্তম অনুভূতি রবীন্দ্রনাথ তা জমা করেছেন কালের খেয়া পারানির কড়িতে। সময়ের সাথে পা ফেলে তাঁর সৃষ্টিকে করেছেন চির নূতন, চির নবীন। তাই রবীন্দ্রনাথ সব সময় প্রাসঙ্গিক। সেই সাথে দিল মনোয়ারা মনু উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ আমাদের ঐতিহ্য, আত্মপরিচয়, আমাদের ইতিহাস এবং ইতিহাসের পটভূমি- যেখান থেকে শুরু তা উপলব্ধি করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। দিল মনোয়ারা মনু রচিত প্রতিটি প্রবন্ধের রচনাশৈলী শব্দ চয়ন ও বাক্য গঠনের ক্ষেত্রে ছিলেন পরিমিত। লেখকের রচনার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তিনি অত্যন্ত সততা ও নিষ্ঠার সাথে মানবিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখতে ছিলেন সচেতন। প্রসঙ্গঁত দিল মনোয়ারা মনু একজন খ্যাতিমান সাংবাদিক। স্বাধীন বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় নারীর অংশগ্রহণ ও অংশীদারিত্বের প্রসারের ক্ষেত্রে অন্যতম পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন সফলভাবে। দীর্ঘ চার দশক লেখালেখির সাথে নিরন্তর যুক্ত ছিলেন । মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত নিজ বৈশিষ্ট্য সমুন্নত রেখে লেখার জায়গাটি ধরে রেখেছিলেন। নির্মোহ প্রচার বিমুখ সাংবাদিক দিল মনোয়ারা মনু নিজ গুণেই ছিলেন অনন্য। দু:খে ভরাক্রান্ত হই যখন জানলাম ১৯৮২ সালে এই প্রবন্ধ গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর তার কোনও গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। দিল মনোয়ারা মনুর প্রকাশিত গ্রন্থ মাত্র একটি- “কবিতা ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা”। কাজী মদিনা ১/৯/২০২৩