"পদ্মানদীর মাঝি" বইয়ের ভূমিকা থেকে নেয়াঃ যদিও কলেজের সহপাঠীদের বাজি ধরে তিনি গল্প পাঠিয়েছিলেন বিচিত্রায়। ‘অতসী মামী' নামের সেই গল্পটি মানিকের জীবনের মােড় ঘুরিয়ে দেয়। সাহিত্যচর্চাই হয়ে ওঠে মানিকের ধ্যানজ্ঞান। একে একে তিনি রচনা করেন জননী (১৯৩৫), দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫), পুতুলনাচের ইতিকথা (১৯৩৬), পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬), শহরতলী (১৯৪০), অহিংসা (১৯৪১), শহরবাসের ইতিকথা (১৯৪৬), চিহ্ন (১৯৪৭), চতুষ্কোণ (১৯৪৮), জীয়ন্ত (১৯৫০), সােনার চেয়ে দামী (১৯৫১), স্বাধীনতার স্বাদ (১৯৫১), ইতিকথার পরের কথা (১৯৫২), আরোগ্য (১৯৫৩), হরফ (১৯৫৪), হলুদ নদী সবুজ বন (১৯৫৬) প্রভৃতি উপন্যাস। অতসী মামী ও অন্যান্য গল্প (১৯৩৫), প্রাগৈতিহাসিক (১৯৩৭), মিহি ও মােটাকাহিনী (১৯৩৮), সরীসৃপ (১৯৩৯), বৌ (১৯৪৩), সমুদ্রের স্বাদ (১৯৪৩), ভেজাল (১৯৪৪), হলুদ পােড়া (১৯৪৫), আজকালপরশুর গল্প (১৯৪৬), ছােটবকুলপুরের যাত্রী (১৯৪৯), ফেরিওয়ালা (১৯৫৩) প্রভৃতি গল্পগ্রন্থ মানিকের উল্লেখযােগ্য সৃষ্টি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস কোনটি এ নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। তার প্রায় সকল উপন্যাসই শিল্পসিদ্ধির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছতে পেরেছে বলে, প্রতিটি রচনাই শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। তবে ‘পদ্মানদীর মাঝি’ পাঠক সমাজে বেশি প্রচলিত ও প্রচারিত। নাট্যায়ণ ও চলচ্চিত্রায়ণের ফলে এই উপন্যাসের বহুকেন্দ্রিক আবেদন সমাজের বিভিন্ন স্তরে পৌঁছে যেতে পেরেছে। দারিদ্র্য ও যৌনাকাঙ্ক্ষার মানবিক চিত্র অংকিত হয়েছে ‘পদ্মানদীর মাঝি'তে। বাংলাদেশের পদ্মাপাড়ের এক অখ্যাত গ্রাম কেতুপুরের জেলে সম্প্রদায়ের নদীকেন্দ্রিক জীবনযাত্রা তাদের সুখ-দুঃখ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, যৌনাকাঙ্ক্ষা, নতুন জীবনের সন্ধানে অনিশ্চিত যাত্রা— সবই উঠেছে এই উপন্যাসের স্বল্প পরিসরে। উত্তাল পদ্মানদীতে ঝড়-বৃষ্টি-স্রোতকে উপেক্ষা করে জেলেদের দুঃসাহসিক অভিযানের কথা লেখক বিশ্বস্ত করে ফুটিয়ে তুলেছেন। বাংলাদেশের পদ্মাপাড়ের ভাঙ্গা-গড়ার সমাজের প্রচলিত আঞ্চলিক ভাষার সংলাপও এ উপন্যাসের আকর্ষণীয় হওয়ার একটি কারণ। কেবল সংলাপ নয়, বিবরণ প্রকাশেও লেখক গ্রহণ করেন ভাষার আঞ্চলিক ভঙ্গিমা। নির্জন নদীতীরে সন্ধ্যারাতে কে হাসিবে? মানুষ নয়, নিশ্চয় নয়! কপিলা বলে, তামুক ফেইল্যা আইছ মাঝি। কুবের নামিয়া আসিয়া তামাকের দলাটা গ্রহণ করে। বলে, খাটাসের মত হাসিস ক্যান্ কপিলা, আই? কপিলা বলে, ডরাইছিলা, হ? আরে পুরুষ! তারপর বলে, আমারে নিবা মাঝি লগে? সাহিত্য সমালােচক ডক্টর শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই উপন্যাসের শ্রেষ্ঠ গুণ হিসেবে যা চিহ্নিত করেছেন তা হলাে— ইহার সম্পূর্ণরূপে নিম্নশ্রেণীর অধ্যুষিত গ্রামজীবনের চিত্রাঙ্কনে সূক্ষ্ম ও নিখুঁত পরিমিতিবােধ, ইহার সংকীর্ণ পরিধির মধ্যে সনাতন মানব প্রবৃত্তিগুলির ক্ষুদ্র সংঘাত ও মৃদু উচ্ছ্বাসের যথাযথ সীমা নির্দেশ।'
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।