মানিকের প্রথম গল্পগ্রন্থ অতসী মামি (১৯৩৫)। এরপরেই দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ প্রাগৈতিহাসিক (১৯৩৭) প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থে মোট নয়টি গল্প গ্রন্থভুক্ত হয়। গল্পগুলো হল প্রাগৈতিহাসিক, চোর, যাত্রা, প্রকৃতি, ফাঁসি, ভূমিকম্প, অন্ধ, চাকরি ও মাথার রহস্য। প্রাগৈতিহাসিক গল্পটি মানিক সাহিত্যের সবচেয়ে আলোচিত অধ্যায়। গল্পটিতে মানিকের শিল্পভাবনা, জীবনবোধ ও নির্মাণশৈলী লেখককে বিশেষ মর্যাদার আসনে আসীন করেছে। শুধু তাই নয়, গল্পের উল্লেখযোগ্য চরিত্র ভিখু হয়ে উঠেছে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে পরিচিত ও শক্তিশালী চরিত্র। জীবনসংগ্রামে সংগ্রামরত ভিখুর মধ্যে বীভৎসতা থাকলেও জীবনবোধ তাকে গতিশীল করেছে। এই গতিশীলতাই ভিখুর কৃতকর্মকে বেগবান করেছে। ভিখুর ভেতরে আশ্চর্যরকম একটা জেদ রয়েছে। সে জেদ যেন ধনতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে। কেউ ভিক্ষা না দিলেও সে গালি দেয়। ভিক্ষা পাওয়াটাও যেন তার অধিকার। প্রবৃত্তির তাড়নায় ভিখু দুর্দম। নিজেকে সে টেনে নিয়ে গেছে গন্তব্যের অভিমুখে। তার জীবনের অপূর্ব প্রাণময়তা, অদম্য শক্তি সবকিছু মিলিয়ে রক্তমাংসের ভিখুকে পাঠক দীর্ঘদিন স্মরণে রেখেছে। মানিকের বাস্তব জীবন অভিজ্ঞতা ও অন্ত্যজ শ্রেণির সমাজের জীবনবীক্ষণ এ ধরনের চরিত্র নির্মাণে প্রণোদনা জুগিয়েছে। ভিখুর যে পরিবেশে জন্ম, তাতে তার যে কার্যকলাপ জোর করে ছিনিয়ে নেবার প্রবণতা সবকিছু মানিয়ে যায়। ভিখু চরিত্রের একটি বড় দিক ক্ষুধা ও কাম। এ দুটি মৌল বিষয় গল্পের অন্তরালে থেকে ভিখুর জীবনপ্রণালিকে পাঠকের সামনে উদ্ভাসিত করে তুলেছে। গল্পের শেষে জীবনদর্শন পাঠককে এ ধ্রুবসত্যের মতো প্রভাবিত করেছে। বিজ্ঞানমনস্ক মানিকের এ ধারণা অমূলক নয়। লেখকের ভাষায়, যে ধারাবাহিক অন্ধকার মাতৃগর্ভ হইতে সংগ্রহ করিয়া দেহের অভ্যন্তরে লুকাইয়া ভিখু ও পাঁচী পৃথিবীতে আসিয়াছে এবং যে অন্ধকার তাহারা সন্তানের মাংসল আবেষ্টনীর মধ্যে গোপন রাখিয়া যাইবে তাহা প্রাগৈতিহাসিক, পৃথিবীর আলো আজ পর্যন্ত তাহার নাগাল পায় নাই, কোনোদিন পাইবেও না।
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।