"মহাপুরুষ" বইটির ভুমিকা থেকে নেয়াঃ মহাকালের গর্ভে এক এক করে ১৬টি বছর বিলীন হয়ে গেছে। অথচ বলতে গেলে সেদিনের কথা মাত্র। সবকিছুই চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভাসছে। তারিখটা ছিল ১৯৭৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর। পরদিন বছরের শেষ। নতুন কর্মক্ষেত্র লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাসে যােগদানের জন্য রওনা হওয়ার ব্যবস্থা সম্পন্ন করেছি। নির্দেশ মতাে দেশ ত্যাগের প্রাক্কালে ঢাকার ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বর রােডের সেই ঐতিহাসিক বাড়িতে নির্ধারিত সময়ে গিয়ে হাজির হলাম। ভেবেছিলাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শুধুমাত্র সৌজন্যমূলক বিদায় পর্ব। সেদিন বাড়িটাতে চুনকাম হচ্ছিল। তাই দুপুরে খাবার পর বিশ্রামের জন্য উনি ছিলেন শেখ হাসিনার কামরায়। আমাকে দেখেই দরজা বন্ধ করার ইশারা দিলেন। উনি বিছানায় শুয়ে। তার ডান হাত আমার দু'হাতের ভেতরে। আমি তখন বাকরুদ্ধ ; নিঃশব্দে ক্রন্দনরত। ১৯৭২-এর জানুয়ারী থেকে ১৯৭৪-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত পুরা তিনটা বছর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে আমি ছায়ার মতাে তার পিছনে অনুসরণ করেছি। কিন্তু এখন বিদায়ের পালা। বেশ কিছুক্ষণ ধরে বঙ্গবন্ধু এক নাগাড়ে কথাবার্তা বললেন। মাঝে-মধ্যে উপদেশ। শক্ৰমিত্র চিহ্নিত করে তিনি অনেক গােপন ঘটনার উপর আলােকপাত করলেন। আমি নিবিষ্ট মনে শুনলাম। অজানা আশঙ্কায় চমকে উঠলাম। এটা এমন একটা সময় যখন নিক্সন-কিসিঞ্জারের নেতৃত্বে মার্কিন প্রশাসনের কারসাজিতে বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে কুড়িগ্রামে একটা দুর্ভিক্ষ হয়ে গেছে। এটা এমন একটা সময় যখন পাক-মার্কিন সৌদী চাপ এবং স্থানীয় সংবাদপত্র ও আমলাতন্ত্রের সুপারিশে (নরহত্যা, নারী ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নি সংযােগের অপরাধ ছাড়া) অন্যান্য পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার স্থগিত, স্বাধীনতাবিরােধী রাজনীতিবিদরা কারামুক্ত এবং কোলাবরেটর অফিসাররা চাকুরীর ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রেখে পুনর্বাসিত হয়ে গেছে। এটা এমন একটা সময় যখন নব্যসৃষ্ট উচ্চ মধ্যবিত্ত আর বুদ্ধিজীবী শ্রেণী (জনাকয়েককে বাধা দিয়ে) সর্বভূক অবস্থায় বঙ্গবন্ধু সরকারের কাছ থেকে আরাে সুবিধা লাভের প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় সমালােচনা মুখর হয়ে উঠেছে। এটা এমন একটা সময় যখন মুক্তিযুদ্ধকালীন অতিবাম আর ধর্মান্ধ দক্ষিণপন্থীদের মধ্যে অশুভ যােগসাজশ হয়ে গেছে। বিদায় মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু হঠাৎ করে বললেন, মুকুল, তুই মুকুলই রয়ে গেলি। তুই আর ফুটলি না। তুই যখন দেশে ফিরবি, তখন হয়তাে আমি আর এই দুনিয়ায় থাকবাে না। আমার রাজনীতি আর জীবন সম্পর্কে অনেকেই লিখবে। কিন্তু তোকেও লিখতে হবে। ১৯৪৬ সালে সেই কোলকাতা থেকেই তুই আমাকে ভালােভাবে চিনিস। আমাকে কাছে থেকে তুই বরাবরই দেখে এসেছিস। তুই তাে আবার অনেকদিন সাংবাদিকতাও করেছিস। তুই-ই পারবি লিখতে। শােন, আমার সম্পর্কে তাের লেখা বই কিন্তু খুব বিক্রী হবে। আমার দোয়া রইলাে। আমি কথা রেখেছি। ১৯৭৬ সালে সুদূর লন্ডনে আমার ভয়ঙ্কর নির্বাসিত জীবন। এবছর লন্ডনের কনওয়ে হলে বঙ্গবন্ধুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠান উপলক্ষে আমার প্রকাশিত চাঞ্চল্যকর বই মুজিবের রক্ত লাল। তখন থেকে আমি বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আর বাঙালী জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে ক্রমাগতভাবে লিখে যাচ্ছি। লেখায় কোনাে কমতি নেই। আমার জীবন ধন্য। কেননা, পাঠক সমাজে আমার লেখা বইগুলাের দারুণ চাহিদা। তাই ১৯৯১ সালে আমার রচিত অন্যতম বই হচ্ছে বংশ পরিচয়সহ জাতির পিতা এবং বাংলাদেশের স্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী গ্রন্থ। সঙ্গত কারণেই নামকরণ করেছি মহাপুরুষ’। আশা করি এই বইটি বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের মধ্যে সাড়া জাগাতে সক্ষম হবে।
(জন্ম: ৯ আগস্ট, ১৯৩০ - মৃত্যু: ২৬ জুন, ২০০৪) একজন বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধা যিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রচারিত স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের চরমপত্রের পরিচালক, লেখক ও কথক ছিলেন। 'চরমপত্র' অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক সাহস, উৎসাহ-উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল৷ সাংবাদিকতা ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ২০০১ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকার থেকে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার লাভ করেন। তিনি একজন কলামিষ্ট৷ তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩৫টি৷ আর আখতার মুকুল ১৯৪৫ সালে দিনাজপুর মহারাজা হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। তিনি দিনাজপুর রিপন কলেজ(ব্রাঞ্চ) থেকে আই এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১৯৪৭ সালে৷ ছাত্রজীবনেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ায় তিনি ১৯৪৮ সালে জননিরাপত্তা আইনে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন এবং ১৯৪৯ সালে জেলখানা থেকে সাজাপ্রাপ্ত আসামী হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে স্নাতক পরীক্ষায় সাফল্য অর্জন করেন৷ ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ক্লাসে ভর্তি হন এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন৷[৩] ১৯৫২ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি রাত ১২টার আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বৈঠকের সময় যে ১১ জন ছাত্রনেতা উপস্থিত হন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম ছিলেন। অন্যান্যরা ছিলেন ভাষাসৈনিক গাজীউল হক, মুহম্মদ হাবিবুর রহমান, মোহাম্মদ সুলতানা, জিল্লুর রহমান, আব্দুল মোমিন, এস এ বারী এটি, সৈয়দ কামরুদ্দীন হোসেইন শহুদ, আনোয়ারুল হক খান, মঞ্জুর হোসেন, আনোয়ার হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এম আর আখতার মুকুল সাংবাদিকতা পেশায় যোগদান করেন৷ সাপ্তাহিক 'নও বেলাল', 'পাকিস্তান টুডে' , দৈনিক আমার দেশ ও দৈনিক সংবাদ ইত্যাদি পত্রিকায় তিনি কাজ করেন। ১৯৫৩ সালের ২৫শে ডিসেম্বর ইত্তেফাকের জন্মলগ্ন থেকে ১৯৬০ সালের জুলাই পর্যন্ত এই পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন৷ ১৯৬১ সালের শেষের দিক থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এম আর আখতার মুকুল আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা ইউডিআই-এর ঢাকাস্থ সংবাদদাতার দায়িত্ব পালন করেন৷ একই সঙ্গে তিনি ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত দৈনিক পত্রিকায় এবং পরে দৈনিক পূর্বদেশেও চাকুরী করেন৷ এম আর আখতার মুকুল ১৯৭১ সালে প্রবাসী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারে যোগদান করে তথ্য ও প্রচার দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷ ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে তিনি বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পান৷ ১৯৭৫ সালের ১লা জানুয়রি তিনি লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে প্রেস কাউন্সিলর হিসেবে যোগ দেন৷ ১৯৭৯ সালের শেষের দিকে এম আর আখতার মুকুল দেশে ফিরে আসেন এবং বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হিসেবে যোগদান করেন৷ ১৯৮৭ সালের আগস্ট মাসে তিনি সরকারি চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন৷