"পদ্মা নদীর মাঝি"বইটির ভূমিকা: উপন্যাস সাহিত্যের আধুনিকতম রূপায়ণ। উপন্যাস সেই আধুনিকতম ও সমগ্রতাস্পর্শী শিল্পপ্রতিমা যেখানে জীবনের আদি-অন্ত, লেখকের জীবনার্থ এবং তাঁর স্বদেশ ও সমকাল বিশেষ নীতি ও নিয়মের মধ্যে নির্দিষ্ট পরিকাঠামােয় বিস্তৃতি লাভ করে। যদিও উপন্যাস শব্দের আক্ষরিক অর্থ কল্পিত কাহিনী তথাপি উপন্যাস শব্দটি গড়ে উঠেছে। অনেকগুলাে বিষয়কে কেন্দ্র করে। এজন্য উপন্যাসমাত্রই কল্পিত কাহিনী হলেও কল্পিত কাহিনীমাত্রই উপন্যাস নয়। বিশ্বাসযােগ্য কোন কাহিনী সুন্দর রসময় উপস্থাপনায় কৌতুহলপূর্ণ বাচনভঙ্গি ও নাটকীয় আবহে উপন্যাসে উপস্থাপিত হয়। সমসাময়িক সমাজ জীবনের সঙ্গে উপন্যাসের সম্পর্ক যতটা নিবিড়, অন্য কোন শিল্পআঙ্গিকের সম্পর্ক ততটা নিবিড় নয়। ইংরেজি Novel-এর প্রতিশব্দ হিসেবে উপন্যাস শব্দটি ব্যবহৃত হয়। বিশিষ্ট ইংরেজ ঔপন্যাসিক E. M. Forster উপন্যাস সম্পর্কে 'Novel is prose narrative of sufficient length to fill one or two volumes.' প্রখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক ও সমালােচক William Somerset Maughamএর মতে উপন্যাস হচ্ছে 'Finally a novel should be entertaining-it is an essential quality, without which no other quality is of any use.' সাহিত্য-সমালােচক শ্রী নারায়ণ চৌধুরী উপন্যাসকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে : উপন্যাস একটা জীবনের অখণ্ড রূপায়ণ এবং সমগ্রতাই তার মর্মবস্তু।... একটা অর্থপূর্ণ অতীতের উৎস থেকে উদ্ভূত হয়ে যে জীবন দূর ভবিষ্যতে বিসর্জিত আর বর্তমান তার সাম্প্রতিক স্থিতিকাল। | বিশিষ্ট সমালােচক শীশচন্দ দাস মনে করেন গ্রন্থাকারের ব্যক্তিগত জীবনদর্শন ও জীবনানুভূতি কোন বাস্তব কাহিনী অবলম্বন করে যে বর্ণনাত্মক শিল্পকর্মে রূপায়িত হয়, তা-ই উপন্যাস। প্রস্তাবনা, সমস্যার উপস্থাপনা, আখ্যানভাগের মধ্যে জটিলতার প্রবেশ, চরম সংকট মুহূর্ত এবং সংকট বিমােচন বা উপসংহার- এই পাঁচটি সূত্রে উপন্যাসকে এক সূতােয় গেঁথেছেন উপন্যাসতত্ত্ববিদ, পন্ডিত ও সমালােচকরা। তারা একথাও বলেছেন, উপন্যাসকে অবশ্যই উপভােগ্য হতে হবে। শুধু তাই নয়, উপন্যাস হবে আনন্দসঞ্চারী ও আনন্দদানকারী। সাহিত্যের অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও জনপ্রিয় শাখা উপন্যাস বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে। তবে বিষয়বস্তু ও প্রবণতা বিচারে উপন্যাসকে নয়টি ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলাে হলােঃ ১. ঐতিহাসিক উপন্যাস ও ইতিহাসকে অবলম্বন করে এ উপন্যাস রচিত হয়। মীর বেমশাররফ হােসেনের বিষাদসিন্ধু’ সার্থক ঐতিহাসিক উপন্যাস। ২. সামাজিক-পারিবারিক উপন্যাসঃ পরিবার ও সমাজজীবনের নানা বিষয়বস্তু, ঘটনা ও ঘাত-প্রতিঘাত অবলম্বন করে এ ধরনের উপন্যাস লেখা হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কৃষ্ণকান্তের উইল’ সার্থক সামাজিক-পারিবারিক উপন্যাস।
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।