কৈফিয়ত বৃহত্তর দিনাজপুর অঞ্চল বঙ্গ সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য পীঠস্থান। সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রচুর উপাদান এই অঞ্চলে। সময় ও সভ্যতার ক্রমবিকাশে এই অঞ্চলে এমন অনেক মহৎ মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল; যারা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া, সামাজিক, সাহিত্য ও সমাজে ঐতিহাসিক বিবর্তনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের কর্মময় জীবনের মাঝে উজ্জ্বল হয়ে আছে আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও সভ্যতার অনেক ইতিহাস। কিন্তু আমরা বেশিরভাগ মানুষ তাঁদের সম্পর্কে ভালোভাবে জানি না। এমনকি অনেকের নিকট এইসব মানুষগুলো আজও অজানা। সে পেক্ষাপটকে সামনে রেখে ২০১৯ সালে আলোচ্য গ্রন্থের কাজ শুরু করেছিলাম। আমার কাছে মনে হয়েছিল, দিনাজপুর অঞ্চলের মাটিতে যেহেতু আমার জন্ম সেহেতু আমারও কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে। প্রত্যেক মানুষের জন্ম হয় কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের প্রত্যাশায়। হয়ত আমরা কেউ তা পালন করি কিন্তু অধিকাংশ মানুষ বৈষয়িক চেতনায় বিভোর হয়ে তারা ভুলে যায় জন্মের কথা, মৃত্যুর কথা। ভুলে থাকাও অস্বাভাবিক নয়। আমাদের পারিবারিকভাবে যে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দায়িত্বশীলতার সৃজনশীলতা দেওয়ার কথা ছিল তা অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারগুলো দিতে ব্যর্থ হয়। পরিবারগুলোর ব্যর্থতা আসলে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার দায়িত্বে যারা থেকেছেন, থাকছেন তাদেরই প্রধান ব্যর্থতা। কারণ রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রকগণ সে দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রত্যেক পরিবারে, গ্রামে ও সমাজে পৌঁছে দিতে ব্যর্থই হয়েছেন। যার ফলে বুঝতে ও জানতে চাওয়ার যে আকাক্সক্ষা মানুষের মধ্যে থাকতে হয় তা অধিকাংশ মানুষের চিন্তা-চেতনায় থাকে না। এবার আসা যাক একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে- আলোচ্য গ্রন্থটির বিষয়বস্তু নিয়ে যখন মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করি তখন যে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়েছে তা খুবই হতাশাজনক। এমনিতেই আমি ঢাকায় থাকি। প্রত্যেক মাসে ঢাকা থেকে গিয়ে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ের বিভিন্ন উপজেলায় যখন যাই তখন বুঝতে পারি কোথায় আছি। নানান উপজেলায় যাওয়ার যে বিশাল একটা খরচ তা এতদিন আমার আয়ের একটা অংশ থেকেই বহন করেছি। তারপরও নানানজন নানানরকম কথা বলেছেন, সহ্য করেছি। আর অনেকেই জেলা বা উপজেলা শহরে বাস করেন কিন্তু তাদের সাথে যোগাযোগ করে গিয়েও দেখা পাইনি। যার ফলে অনেকের বাপ-দাদার জীবনী এ গ্রন্থে অন্তর্ভূক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমার একটা মুদ্রাদোষ আছে, সেটা হচ্ছে- আমাকে কেউ বেশি বিরক্ত করলে তার বিষয়টা আস্তে করেই মাথা থেকে সরিয়ে ফেলি। তাদের সম্পর্কে আমার ধারণা জন্ম হয়, তারা চাচ্ছে না। তারপরও বিভিন্ন বই-পত্রে ও অনলাইনে তাদের সম্পর্কে জানার জন্য খোঁজাখুঁজি করি। কারও কারও সামান্য তথ্য নানান জায়গায় পেলেও বেশির ভাগ মানুষের তথ্য পাইনি। দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা করেছি, এ গ্রন্থটা প্রকাশ করার। কিন্তু সবমিলিয়ে আমার যে টানাপোড়েনের জীবন! তা করতে পারিনি। দীর্ঘদিন পাণ্ডুলিপিটা পড়ে ছিল। চলতি বছরের ২১ মার্চ জীবনে প্রথম দেশের বাইরে ভারতে গেলাম। ট্রেনযোগে কলকাতায় যাওয়ার পর ভিন্ন পৃথিবীর সন্ধান পেলাম। কলকাতায় গিয়ে উঠলাম লেখক-গবেষক মহেশ^র প্রসাদ লাহিড়ী দাদার বাড়িতে। তারপর কলকাতা থেকে দিল্লি গেলাম। ২৬-২৮ মার্চ দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সার্ক সাহিত্য সম্মেলনের ডেলিগেট হিসেবে অংশগ্রহণ করার পর নিজেকে আবার একবার জানার সুযোগ পেলাম। আসলে পৃথিবী না ঘুরলে জ্ঞানের পরিধি বুঝা যায় না। সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে উঠলাম মামার বাড়িতে। সেখানে কয়েকদিন থেকে আলোচ্য গ্রন্থের কাজে অখণ্ড দিনাজপুরের আরেকটা অংশ উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরে গেলাম। কিন্তু সময় ও অর্থের সংকটের কারণে সেখানে বেশিদিন থাকতে পারিনি। পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক বন্ধুবর তুহিন শুভ্র মণ্ডল, লেখক-গবেষক বন্ধুবর শুভঙ্কর রায়, অগ্রজ কবি মৃণাল চক্রবর্তী, অগ্রজ লেখক-গবেষক সমিত ঘোষের আপ্যায়ন আমাকে মুগ্ধ করেছে। সেখানে আরও নানানজনের সাথে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু সবকিছু ব্যাটে-বলে মিলেনি। একরাশ নিরাশা নিয়েই ভারত থেকে দেশে ফিরে আসি। দেশে ফিরে এসেই মনে হলো যত কষ্টই হোক এ বছর অখণ্ড দিনাজপুর জেলার চরিতকোষ গ্রন্থটা প্রকাশ করবই। তারপর শুরু করি বইয়ের যাবতীয় কাজ। এ বইয়ের কাজ করতে গিয়ে প্রচুর অর্থকষ্টে পড়ে গেলাম। কারণ নিজের বইয়ের কাজ করতে গেলে জীবনের অন্যান্য যাবতীয় বিষয় ভুলে যাই। ব্যবসায় মন্দা চলতে শুরু করে। ব্যবসার দিকে একরকম চোখ ফিরিয়েই নিয়েছি। একরকম পাগল হয়ে থাকি। তা কাউকে বুঝতেই দিই না। তারপর বিভিন্ন জনের কাছে টাকা ধার করা আরম্ভ করি। মাস শেষে তো বাসা ভাড়া দিতে হয়, খাইতে হয়, সংসার চালাতে হয়, অফিস ভাড়া দিতে হয়। টাকা ধার করতে গিয়ে আরেকবার নিজেকে চিনতে পারলাম। এই সংকটকালে যারা আমাকে টাকা ধার দিয়েছেন তারা হলেন- লেখক ও ডাক্তার তারিকুল ইসলাম, লেখক-গবেষক আলী ছায়েদ, লেখক-গবেষক বিধান দত্ত, লেখক-গবেষক হাফিজা খাতুন, কবি ও গল্পকার শফিক হাসান, কবি ও কথাসাহিত্যিক রণজিৎ সরকার এবং মুক্তচিন্তার প্রকাশক শিহাব বাহাদুর। যারা দিতে চেয়েও দেননি তাদের নামগুলো উচ্চারণ করলাম না। আমার এ গ্রন্থের কাজ করতে গিয়ে যাদের সহযোগিতা নানাভাবে পেয়েছি তারা হলেন- কবি তুষার শুভ্র বসাক, রাজনীতিক ও শিক্ষক ইমরান আল-আমিন, লেখক-গবেষক নয়ন তানবীরুল বারী, রাজনীতক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আবুল কালাম আজাদ। আরও একজনের কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সহকারি অধ্যাপক অনুপ সাদি। এই গ্রন্থটা নিয়ে যার সাথে বেশি কথা বলেছি, পরামর্শ নিয়েছি এবং যুক্তি-তর্ক করেছি। তিনি সবসময় এ গ্রন্থটার খবরাখবর রেখেছেন। নিজের সম্পর্কে এতকিছু লেখার অন্যতম কারণ হলো- এ গ্রন্থ লেখার পেছনের যে গল্প তা কৈফিয়তের মাধ্যমে লিখে রাখলাম। কারণ আমরা সবাই সামনের ইতিহাসটাই বেশি জানি, পেছনের ইতিহাসটা জানার কোনো চেষ্টা করি না। এভাবে প্রত্যেক বিখ্যাত ও অখ্যাত বই লেখার পেছনে একটা গল্প থাকে যা অনেক ক্ষেত্রেই আমরা অনেকেই এড়িয়ে গিয়ে ভালো ভালো কথা বলি। আমার কাছে তা মনে হয় নিজের সত্তার সাথে লেখকের একরকম প্রতারণা করা। এটাও দেখা যায়, কতকগুলো বইয়ের কোনো ভূমিকাই নেই। সরাসরি বইয়ের লেখার মধ্যে ঢুকতে হয় পাঠককে। আমার দৃষ্টিতে যা দৃষ্টিকটু। এ গ্রন্থটি দুটো অংশে ভাগ করেছি, প্রথম অংশে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন, দ্বিতীয় অংশে যারা এখনও বেঁচে আছেন। চরিতকোষের ধর্ম অনুযায়ী মৃত ব্যক্তিদের নিয়ে লেখা উচিৎ কিন্তু নিয়মের বাইরে গিয়ে যাঁরা এখনও বেঁচে আছেন তাদের নিয়ে একটু লিখে গেলাম, তাদের একটু সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। আমাদের দেশে জীবিত থাকা অবস্থায় সেভাবে গুণিদের আমরা সম্মান করতে জানি না অথচ ওই ব্যক্তিরাই মারা যাওয়ার পর তাদের নিয়ে আমরা মাথায় তুলে নাচানাচি করি। তাদের নিয়ে শোকসভা, আলোচনা সভা ও স্মারকগ্রন্থ পর্যন্ত করে থাকি।
অজয় কুমার রায় ১৯৮৫ সালের ২৫ আগস্ট ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার দেওনাপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন অজয় কুমার রায়। পিতা ললিন বর্মন, মাতা সেবা রানী। পিতা-মাতার ৩ সন্তানের মধ্যে তিনি জ্যেষ্ঠ। কিশোর বয়স থেকেই লেখালেখিতে নিবেদিত, সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে জড়িত। মাটি ও মানুষের প্রতি অনুরাগ তার মজ্জাগত। বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য প্রায় সব জাতীয় দৈনিক পত্রিকা, সাহিত্য ম্যাগাজিন, ছোট কাগজ, গুরুত্বপূর্ণ সংকলনে অসংখ্য কবিতা, গল্প, ফিচার ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। জীবনের বেশিরভাগ অংশই শিল্প-সাহিত্য চর্চায় সম্পৃক্ত ছিলেন, এখনো পথ চলছেন বিরতিহীন। বাংলাদেশের সংস্কৃতিচর্চার সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি থেকে ২০১১ সালে ‘তরুণ লেখক প্রকল্প’র চতুর্থ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। সান্নিধ্য পেয়েছেন খ্যাতিমান অনেক লেখক ও দেশসেরা বুদ্ধিজীবীর। ছয় মাস দীর্ঘ এই কর্মশালা থেকে তিনি জীবনের বোধ খুঁজে পেয়েছেন। তার সাহিত্য-মানস ও পঠন-পাঠনেও ভূমিকা রাখে এই কর্মশালা। এছাড়াও ২০২৩ সালের ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সার্ক সাহিত্য সম্মেলনে বাংলাদেশের ১১ জনের মধ্যে তিনিও ছিলেন। এ সার্ক সাহিত্য সম্মেলনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থের জন্য সার্ক সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করে সার্ক কর্তৃপক্ষ। প্রকাশিত গ্রন্থ- ‘ধ্রুবতারা’, ‘পাশা ও দেহবাস’, ‘এই শহরে ভালোবাসা বিক্রি হয়’, ‘কতটা ভালোবাসলে ভালোবাসা কয়’ ও ‘ঠাকুরগাঁও জেলার ইতিহাস’ এবং ‘কমিউনিস্ট আন্দোলন ও বিপ্লবী বরদাভূষণ চক্রবর্তী’। সম্পাদনা গ্রন্থ : ‘তেভাগার প্রাণস্পন্দন হাজী মোহাম্মদ দানেশ’, ‘তেভাগার প্রাণপুরুষ গুরুদাস তালুকদার’ ও গণচীনের স্থপতি মাও সেতুংয়ের ‘অনুশীলন ও দ্বন্দ্ব সম্পর্কে’। দীর্ঘদিন সম্পাদনা করেছেন সাহিত্যপত্রিকা ‘টাঙ্গন’। সাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখায় লাভ করেছেন ‘পীরগঞ্জ প্রেসক্লাব সম্মাননা-২০২২’ এবং পরমেশ^রী স্মৃতি সংঘ ও সাহিত্য সংসদ কর্তৃক ‘গুণীজন সম্মাননা-২০২১।’