বোতল ভ‚ত আরমান গরীব কৃষক। নিজের কিছু জমি আছে। তিন ছেলে দুই মেয়ে আর স্বামী স্ত্রী মোট সাতজনের সংসার। এ অল্প জমি চাষ করে সাত জনের সংসার চলেনা। তাই অন্যের জমি বর্গা চাষ করতে হয়। তাতে অর্ধেক ফসল জমির মালিকের আর অর্ধেক ফসল তাদের। এভাবে কোনরকম দিনগুলো চলছিল আরমানের। আরমানের ছোট্ট একটা টিনের ঘর। দুইপাশে দুইটা খাট, আসবাবপত্র বলতে তেমন কিছু নেই। গ্রামের ভিতরে বাঁশের ঝাড়, ঝাড়ের মাঝখানে আরমানের বাড়ি। বাঁশগুলো নুইয়ে আছে আরমানের চালের উপরেদিনের বেলাতেই সূর্যের আলো খুব কম দেখা যায়। অন্ধকার বিদঘুটে একটা জায়গা। রাতের বেলা শুরু হয় ঝারের উপরে ভ‚ত-পেতœীর মেলা। এ বাঁশ থেকে লাফ দিয়ে ওই বাঁশে গিয়ে ওরা লাফালাফি খেলা করে। তখন বিকট শব্দ হয়, মনে হয় যেন বাঁশঝাড়গুলো ভেঙ্গে ঘরের উপর পড়ে যাচ্ছে। ভ‚ত-পেতœীরে খেলাগুলো দেখেই জীবন থেকে সময়গুলো পার করে দিচ্ছেন এক এক করে অনেকগুলো বছর। ছোট ছোট বাচ্চাগুলো আগে চিৎকার করে উঠতো। সময়ের সাথে সাথে এখন তাল মিলিয়ে নিয়েছে। এখনো ওরা ভয় পায় কিন্তু চুপ করে থাকে। আরমানের বড় ছেলের নাম আরিফ। এবার ক্লাস ফাইভে পড়ে। ভীষণ দুষ্টু সে। গ্রামের পাশ থেকে ওপাশে চড়ে বেড়ায় সে। বড় বড় গাছের মগডালে উঠে চড়–ই পাখি আর টুনটুনির বাসা খুঁজে। পাখিগুলো ধরে ধরে সে বাজারে বিক্রি করে। ছোট ভাই-বোনরা ভ‚ত-পেতœীদের ভয় পেলেও সে একদম ভয় পায় না। একদিন শেওড়া গাছের মগডালে উঠেছিল পাখির বাসা খুঁজতে। পাখির বাসার কাছে গিয়ে দেখে ডালের মাঝে একটা সাপ মুড়িয়ে রয়েছে। ও আস্তে আস্তে অন্য একটা ডাল থেকে ছোট একটা ডাল ভেঙ্গে সাপের মাথায় আঘাত করে। অতঃপর সাপটি গাছ থেকে পড়ে যায়। এবার পাখির বাসা থেকে সে পাখির দুটি ছানা খুঁজে পায়। তা নিয়ে সে গাছ থেকে নেমে পড়ে। তখন ঠিক দুপুর বারোটা বাজে। এ সময় ভ‚ত পেতœীগুলো তাদের খাবারের সন্ধানে ছুটে বেড়ায়। কখনো কুকুর বিড়াল কিংবা মানুষের বেশে। একটা লেটো ভূত মানুষের বেশ ধরে আরিফের সাথে সাথে হেঁটে যাচ্ছে। আরিফকে জিজ্ঞেস করল কিরে আরিফ যাবি নদীর ধারে মাছ ধরতে। আরিফ থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তার বন্ধু বাচ্চুর চেহারা অবিকল। কিন্তু বাচ্চুর বাড়িতো গ্রামের শেষ প্রান্তে সেখানে আসবে কেমন করে? আরিফ ভ‚তটার পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকে দেখলো। সে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু তার পিছনে কোন ছায়া পড়ছে না। প্রতিটা মানুষেরই রোদের মাঝে ছায়া পড়ে কিন্তু তার ছায়া নেই। আরিফ তাৎক্ষণিক বুঝতে পেরে গেল এটা মানুষরূপী ভ‚ত। আরিফ তিন হাত পিছনে গেলো। লা ইলাহা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ্ বলে একটা সূরা পাঠ করলো। নিজের বুকে হাত দিয়ে তিনবার আল্লাহ্র নাম নিয়ে সামনে ফুঁক দিল সাথে সাথে ভ‚তটা মিলিয়ে গেলো। তারপর আরিফ বাড়ি চলে এলো। আরিফ বয়সে ছোট হলেও তার সাহস ছিল দুর্দান্ত। আরিফদের বাড়ির পাশে সামনেই একটা বাগান বাড়ি আছে। বহু পুরাতন বাগান বাড়িতে। এখানে তেমন কেউ থাকেনা। নামে বাগান বাড়ি আসলে বাগান বলতে কিছু নাই। সে পুরনোদিনের গাছগাছালিতে ভরপুর। তার পাশে বিশাল একটা পুকুর। বাড়িওয়ালা ঢাকায় থাকে। বছরে একবার আসে বাড়িতে। এসে এলাকার লোকজন নিয়ে মাছ ধরে ফল ফলাদি সংগ্রহ করে। সকালে আসে সারাদিন থেকে বিকেলে চলে যায়। এলাকার একটা বৃদ্ধ লোক আছে এই বাড়ির কেয়ারটেকার। লোকটি অনেক ভালো সহজ সরল মনের মানুষ। গ্রামের ছেলেরা বড়শী দিয়ে মাছ ধরতে আসলেও তিনি কিছু বলে না। তিনি মনে করেন পুকুরের মালিক বিশাল বড়লোক, ওনার কোন কিছুর অভাব নেই, গ্রামের ছোট ছোট অভাবী ছেলেমেয়েরা যখন মাছ ধরতে আসে এবং মাছ ধরে নিয়ে যাই তাতে সামান্যতম হলেও অভাব গোচর হয় এবং ছেলে মেয়েরা অনেক আনন্দ বোধ করে। অনেকদিন পরে আরিফ আজ পুকুর ধারে গেল মাছ ধরতে। একহাতে বড়শী অন্য হাতে মাছের খাদ্য আটার গুলা। পুকুর ধারে গিয়ে বড়শীতে আটার গুলা পেঁচিয়ে মাছ ধরার জন্য টুপ ফেলল। হঠাৎ আরিফের মনে হল মাছ ধরে রাখার মত কোন পাত্র কিংবা ব্যাগ সে আনতে ভুলে গেছে। তার মাথায় বুদ্ধি এলো যে, পুকুর পাড়ে ছোট্ট একটা গর্ত করলে তার ভিতরে মাছ রাখা যাবে। পরে না হয় বড়শীর সুতো দিয়ে গেঁথে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া যাবে। পুকুর পাড়ে গর্ত খুঁড়তে খুঁড়তে হঠাৎ দেখতে পেল মুখ আটকানো একটা বড় বোতল। আরিফ বোতলটি হাতে নিল। বোতলটির নীল বর্ণের থাকায় ভিতরে কি আছে মোটেই দেখা যাচ্ছিল না। আরিফ সাহস করে বোতলের মুখটি খুলে ফেলল। বোতল খোলার সাথে সাথে বোতলের ভেতর থেকে প্রচুর ধোঁয়া বের হতে থাকে। বোতলের ভেতরে ছিল চারশত বছর আগের পুরনো বীভৎস ভয়ঙ্কর এক ভ‚ত। ভ‚তটা ছাড়া পেয়ে আরিফের শরীরের ভিতরে পৌঁছে গেল। আরিফের নাক দিয়ে কান দিয়ে গড় গড় করে রক্ত পড়তে শুরু করল। আরিফ অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করতে শুরু করল। বাগান বাড়ির সেই কেয়ারটেকার বৃদ্ধ লোকটি শুনতে পেল। তিনি দৌঁড়ে আরিফের কাছে চলে এলো। এসে দেখতে পেলো আরিফের চেহারাটা বীভৎস হয়ে গেছে, নাক কান ও মুখ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ে পুকুর পাড়টা রঞ্জিত হয়ে গেছে। তিনি চিৎকার করে মানুষ ডাকলো। সাথে সাথে অনেক লোকজন জমায়েত হয়ে গেল। ওরা আরিফকে তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিল। আরিফের বাবা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। কয়েকজন ডাক্তার এসে আরিফকে দেখে তার বাবাকে বলল আমরা কোন কিছুই করতে পারবো না, তার অবস্থা খুব খারাপ আপনারা বাড়ি নিয়ে যান, আল্লাহ্কে ডাকুন তিনিই সকল কিছুর মালিক। অতঃপর আরিফকে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। কোন উপায়ান্তর না দেখে শেষ ভরসায় আরিফকে এক বড় কবিরাজ এর কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। কবিরাজ আরিফকে দেখে চোখ বড় বড় করে ফেলল। তিনি তার মাথায় হাত চাপরাতে লাগলো। আর বলতে লাগলো কি সর্বনাশ হয়ে গেল। এখন বুঝি পুরো গ্রামটিকে খেয়ে ফেলবে। আরিফের বাবা কিছুই বুঝতে না পেরে হুজুরকে বলল কি হয়েছে হুজুর আমাকে খুলে বলেন। তখন হুজুর বলতে শুরু করলো, আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে এই দুষ্টু এবং ভয়ংকর ভ‚তটাকে আমি বোতলের ভিতরে ভরে পুকুর পাড়ে পুঁতে রেখেছিলাম। এ দুষ্ট ভ‚তের চক্রে পড়ে বহু ছেলে মেয়ের প্রাণহানি হয়েছে। আজ সে ছাড়া পেয়ে আরিফের শরীরের ভিতরে ঢুকে ওর কলিজাটাকে টেনে হিছড়ে দুই টুকরো করে ফেলে। আল্লাহ্ই ভালো জানে আর না জানি কতো মানুষের প্রাণনাশ হয়। হুজুরের কথা শুনতে শুনতে আরিফের চোখ দুটি বন্ধ হয়ে গেল। আরিফের বাবা বোবার মত নিথর দুটি চোখে তাকিয়ে শুধু দেখতে থাকলো। এভাবেই জীবন প্রদীপ শেষ হয়ে গেল আরিফের।