"ভারততত্ত্ব" বইয়ের ভূমিকা: ইসলাম, মুসলমান, মনুষ্যত্ব ও মানবতার শত্রুরা জগদ্বিখ্যাত বীর সুলতান মাহমুদের ভারত বিজয়কে ভারত আক্রমণ’ বা ‘সােমনাথ-মন্দির লুণ্ঠন’ এবং তাঁকে লুটেরা' বলে অভিহিত করলেও আমরা আমাদের ধর্ম, কৃষ্টি ও সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল মুসলমানরা তাকে ভারতে মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠাকারী মহান গাজি বা বীর বলে অভিহিত করে থাকি এবং এ ঘটনাকে আমরা একজন গাজি ও বীরের রাজনৈতিক মিশন বলে অভিহিত করি। এর কৈফিয়ত-স্বরূপ আমরা এতটুকুই বলতে পারি যে, আমরা মুসলমানরা দর্পণের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের শত্রুদের চেহারা দেখি না ; এবং আমরা আমাদের শত্রুদের চোখ ও অভিজ্ঞতা দিয়ে জীবনকেও দেখি না, জগৎকেও দেখি না, তাই আমরা তাদের অনুভূতি ও তাদের ভাষায় কথা বলি না বা সেই মতে কোনাে ঘটনার মূল্যায়নও করি না। সুতরাং সুলতান মাহমুদকে আমরা তথাকথিত 'লুটেরা', লুণ্ঠনকারী’ বা আক্রমণকারী' বলে অভিহিত করি না। আমরা তাঁকে, সিন্ধুবিজয়ী বীর মুহম্মদ ইবনে কাশিমের পরে ভারতে বা উপমহাদেশে মুসলমানদের দ্বিতীয় রাজনৈতিক মিশন পরিচালনাকারী মহান বীরসেনানী ও গাজি বলে অভিহিত করি। কেননা, ভারতে মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ তারাই পরিষ্কার করে গিয়েছেন। ধর্ম, ইতিহাস ও ঐতিহ্যগত দিক থেকে তাঁরা মুসলমানদের পূর্বসূরি। তাই এতে আঞ্চলিক, জাতিগত ও ভৌগােলিক সীমারেখার ঊর্ধ্বে দেশীয় শত্রুদের চেয়ে তথাকথিত ‘বিদেশি মুসলমানরাই আমাদের পরম আপনজন। মনে রাখতে হবে যে, বাবরি মসজিদ ধ্বংসকারী ও মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্য বিনাশকারী ঘৃণিত শত্রুদের দেশি-বিদেশি কোনাে সহযােগী ও তাদের মিত্ররা কখনােই মুসলমানদের বন্ধু এবং আপনজন বলে বিবেচিত হতে পারে না। সুতরাং তারা সর্বত্থায় পরিত্যাজ্য এবং তাদের কৃত ঐতিহাসিক মূল্যায়ন-যা কিনা ইসলাম, মুসলমান, মনুষ্যত্ব ও মানবতার পরিপন্থী-তা সর্বৰ্থায় ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যানের যােগ্য। সেক্ষেত্রে মুসলমানদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাচেতনাজাত উপলব্ধিই একমাত্র কাম্য।
আবু রায়হান আল-বেরুনি (৯৭৩- ১০৪৮) ছিলেন বিশ্বখ্যাত আরব শিক্ষাবিদ ও গবেষক। তিনি ছিলেন গণিত, জ্যোতিঃপদার্থবিদ, রসায়ন ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে পারদর্শী। ছিলেন ভূগোলবিদ, ঐতিহাসিক, পঞ্জিকাবিদ, দার্শনিক, চিকিৎসা বিজ্ঞান, ভাষাতত্ত্ববিদ ও ধর্মতত্ত্বেরও নিরপেক্ষ বিশ্লেষক। নির্ভীক সমালোচক ও সঠিক মতামতের জন্য যুগশ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃত ছিলেন। তিনি একটি অতি সাধারণ ইরানি পারিবারে খাওয়ারিজমের শহরতলিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাল্যকাল অতিবাহিত হয়েছিলো আল-ইরাক বংশীয় রাজপতি বিশেষ করে আবু মনসুর বিন আলী বিন ইরকের তত্ত্ববধানে। তিনি সুদীর্ঘ ২২ বছর রাজকীয় অনুগ্রহে কাটিয়েছেন। অধ্যয়নকালেই তিনি তার কিছু প্রাথমিক রচনা প্রকাশ করেন এবং প্রখ্যাত দার্শনিক ও চিকিৎসাশাস্ত্রজ্ঞ ইবন সিনার সাথে পত্র বিনিময় করেন। আল বিরুনির মাতৃভাষা ছিল খাওয়ারিজিম আঞ্চলিক ইরানি ভাষা। কিন্তু তিনি তার রচনাবলি আরবিতে লিখে গেছেন। তিনি গ্রিক, হিব্রু ও সিরীয় ভাষাও জানতেন। সুলতান মাহমুদ খাওয়ারিজম দখল করার পর তিনি গজনি চলে যান। এখানেই তার জ্ঞানচর্চার স্বর্ণযুগের সূচনা হয়। গজনির সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি ভারতে প্রায় ১২ বছর অবস্থান করেন। এখানে সংস্কৃত ভাষা শেখেন এবং হিন্দু ধর্ম, ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি, দেশাচার, সামাজিক প্রথা, রাতিনীতি, কুসংস্কার ইত্যাদি বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি ভারতীয় কিছু আঞ্চলিক ভাষায়ও জ্ঞান লাভ করেছিলেন। তিনি এই এক যুগের অধ্যায়ন ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দ্বারা রচনা করেন তার বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ কিতাবুল তারিকিল-হিন্দ। তিনি সর্বমোট ১১৪টি গ্রন্থের উল্লেখ তিনি নিজে করেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নামে একটি হলের নামকরণ করা হয়। তিনি ৬৩ বছর বয়সে গুরুতর রোগে আক্রান্ত হন। তার পরও তিনি ১২ বছর বেঁচেছিলেন। ১৩ ডিসেম্বর ১০৪৮ খ্রিষ্টাব্দে, ৪৪০ হিজরি ২ রজব তিনি ৭৫ বছর বয়সে মারা যান।