চলচ্চিত্র অধ্যয়ন ও গবেষণা গত শতাব্দীর বিভিন্ন প্রজন্মকে শিখিয়েছে যে, চলচ্চিত্র শিল্পকর্ম শুধু তার নির্মাতাদের নিজস্ব অভিপ্রায় প্র্রকাশের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলোই ধারণ করে না, বরং জনগোষ্ঠীর ভাষা, আকাক্সক্ষা, আদর্শ এবং জাতীয়তার একীভূত রাজনৈতিক অনুভূতির রূপও প্রকাশ করে। একটি দেশের চলচ্চিত্রে তার জাতীয় জীবনের বৈশিষ্ট্যগুলো অনুসন্ধানের প্রশ্নটি তখনই জরুরি হয়ে দেখা দেয়, যখন দেশটি বিজাতীয় সংস্কৃতির আক্রমণ থেকে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্য প্রতিরক্ষার ভূমিকায় চলচ্চিত্রকে দায়িত্ব পালনের জন্য ডেকে নেয়। চলচ্চিত্রের নির্মাণ কলাকৌশল ও শৈল্পিক আবেদন নিয়ে নানা মতবাদ থাকলেও এর অভ্যন্তরে নিহিত সমাজতত্ত্বের বিশ্লেষণের বিষয়ে সবাই একমত। চলচ্চিত্র যেহেতু নানা রকম চলন্ত দৃশ্যপ্রতিমার মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে স্পর্শ করে, তাই দেশের জাতীয় উদ্দেশ্য, সাংস্কৃতিক মূল বৈশিষ্ট্য চলচ্চিত্রেই পাওয়া সম্ভব। চলচ্চিত্রের অভ্যন্তরে যে জনতা, প্রদর্শন কক্ষের জনতা, চলচ্চিত্রের ক্যামেরার পেছনের জনতা—সব জনতার চাহিদা ও বৈশিষ্ট্য জাতীয় চলচ্চিত্রের আলোচনার মুখ্য বিষয় হতে পারে। পঞ্চাশ বা ষাট দশকে ইউরোপের চলচ্চিত্রে ‘জাতীয় চলচ্চিত্রে’র ধারণাটি এসেছিল অনেকটা অজ্ঞাতসারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার হলিউডের চলচ্চিত্র সাম্রাজ্যবাদের বিপক্ষে ইউরোপের তথাকথিত শিল্পবোদ্ধা দেশগুলো আত্ম-স্বাতন্ত্র্যরক্ষার তাগিদেই ফরাসি চলচ্চিত্র, ইউরোপীয় চলচ্চিত্র, জার্মান চলচ্চিত্র, ইতালিয়ান চলচ্চিত্র—এ রকম দেশমুখী ধারাকে অভিধাসিক্ত করেছিলেন। সেই সময় জাতীয় চলচ্চিত্রের বৈশিষ্ট্য নিয়ে কোনো আদর্শিক মডেল তৈরি না করে চলচ্চিত্রবেত্তারা যার যার দেশের চলচ্চিত্র-প্রস্তাব নিয়ে নানাবিধ আখ্যানের ইতিহাস বয়ান করেছেন। বিদ্বজ্জনের তাত্ত্বি¡ক বিবেচনাগুলোর চলচ্চৈত্রিক প্রয়োগ ও অনুশীলনের ফলে এই শিল্পটি দার্শনিকভাবে এবং প্রকৌশলগতভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে। এই অনুশীলন, সমালোচনা ও প্রদর্শন কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে শিল্পমাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্র তার নানাবিধ কলাকৌশল গ্রহণ করতে শেখে। বিস্তৃত হয় এর আস্বাদন ক্ষমতা, আর এভাবেই আজকের চলচ্চিত্রশিল্প মহীরুহসম প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন করে। মূলত কথাসাহিত্যই আহমদ বশীরের বিচরণভূমি, কিন্তু গত শতাব্দীর সত্তর দশকে তাঁর প্রথম যৌবনের মগ্ন চলচ্চিত্র-মনস্কতা দীর্ঘদিন পরে আজ তাড়িত করেছে এই আলোচনায়। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ, ‘অন্য পটভূমি’ প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে, যেটি ‘হুমায়ুন কাদির সাহিত্য পুরস্কারে’ ভূষিত হয়েছিল। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘নায়ক কাপুরুষ’। ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমির ‘উত্তরাধিকার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় প্রথম উপন্যাস ‘উরুরং চুরুরং খেলা’। সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর কয়েকটি বই: ‘মুদ্রারাক্ষস’ (২০১৯), ‘উনিশ শ’ তিয়াত্তরের একটি সকাল’ (২০১৯), ‘স্বাধীনতার পরের এক পরাধীনতা’ (২০১৭), ‘তিথিডোর : মুক্তিযুদ্ধের একটা উপন্যাস হতে পারতো’ (২০১৬), ‘অবাস্তব বাস্তব’ (২০১৫)।
Title
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র : দেশকাল ও শিল্পরূপ (১৯৪৭-২০১৭)
আহমদ বশীরের প্রথম গল্পগ্রন্থ অন্য পটভূমি প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে, যা হুমায়ুন কাদির সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিল ১৯৮২-তে। তারপর আরো দুটো ছোটগল্প সংকলন প্রকাশিত হলেও লেখক কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সাহিত্যজগৎ তেকে স্বেচ্ছা-নির্বাসনে চলে যান। হঠাৎ মৌনতা ভেঙে, কোনো এক মহাশক্তির কল্যাণে, আবার লেখালেখি শুরু করেছেন। রাহুচক্রের আহ্বানে আবার যদি কৃষ্ণগহ্বরে হারিয়ে যান এই লেখক, কারও বুঝি কিছু বলার থাকবে না সেই দিন।