যদি প্রশ্ন করা হয়, বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে করুণ উপন্যাস কোনটি! কেউ পড়ুক বা না পড়ুক,চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারবে এটি দেবদাস। হ্যা,বলা হয়ে থাকে বাংলা সাহিত্যের সবথেকে করুণ উপন্যাস শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর দেবদাস। ১৯১৭ সালে প্রকাশিত দেবদাস উপন্যাসটি প্রকাশের পরপরই ভীষণ জনপ্রিয়তা পায় এবং বেশ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়। সবচেয়ে বড় কথা উপন্যাসটি বর্তমান সময় পর্যন্ত তার জনপ্রিয়তা এক বিন্দুও হারায় নি। আমরা যারা একটু বড় হয়েছি, তারা সবাই হয়ত দেবদাস-পার্বতীর গল্পটা হালকাভাবে জানি। দেবদাসের দুষ্টামির মধ্যমে উপন্যাসটা শুরু হলেও এক করুণ পরিণতির মাধ্যমে শেষ হয়। পাশাপাশি বাড়িতে ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠা দেবদাস আর পার্বতী ছিলো একে অপরের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। দেবদাসের দুষ্টামি আর পড়াশোনায় মনযোগহীনতার জন্য তাকে চলে যেতে হয় বাহিরে পড়াশোনা করতে। সময়ের সাথে সাথে পার্বতীর মনে জমতে থাকে দেবদাসের প্রতি ভালবাসা এবং বড় হওয়ার সাথে সাথে তা বাড়তেই থাকে। ১০ বছর পর পার্বতীর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে দেবদাস ফেরত আসে। কিন্তু আশেপাশের সমাজ-ব্যাবস্থা, উচুঁ-নিচু পরিবারের ভেদাভেদ এবং প্রথমদিকে দেবদাসের অপারগতা সম্পর্কের পরিণতি কে করে তোলে ভয়াবহ। পার্বতীর অন্যত্র বিবাহ, দেবদাসের পার্বতীর প্রতি ভালবাসা দেবদাসকে একটু একটু করে দূর্বল করে দেয়। চন্দ্রমুখী নামক নতুন চরিত্র উপন্যাসকে দেয় অন্য মাত্রা। এ এক ত্রিমাত্রিক প্রেমকাহিনী।
বাঙালির জীবনের আনন্দ-বেদনাকে সাবলীল স্বচ্ছন্দ ভাষায় যে কথাশিল্পী পরম সহানুভূতি ভরে তুলে ধরেছেন বাংলা সাহিত্যে, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৭৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, হুগলি জেলার ছোট্ট গ্রাম দেবানন্দপুরে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শরৎচন্দ্র। দারিদ্র্যের কারণে তাঁর শৈশবকাল বলতে গেলে মাতুলালয় ভাগলপুরেই কেটেছে। দারিদ্র্যের কারণে ফি দিতে না পেরে বেশ কয়েকবার স্কুল বদলিও করতে হয়েছিলো ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত ও মেধাবী শরৎচন্দ্রের। এন্ট্রান্স পাস করে কলেজে ভর্তি হলেও এফএ পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে না পেরে পরীক্ষায় বসতে পারেননি। দারিদ্র্য যখন শিক্ষাজীবনে অব্যহতি টানলো, তারপরই শুরু হলো আপাত সাধারণ এই মানুষটির বর্ণাঢ্য কর্ম ও সাহিত্যজীবন। এ সময় প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্টের বাড়িতে আয়োজিত সাহিত্যসভায় লেখালেখির অনুপ্রেরণা ফিরে পেলেন যেন আবার। যার ফলশ্রুতিতে বাংলা সাহিত্য পেয়েছিলো বড়দিদি, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা’র মতো কালোত্তীর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর উপন্যাস সমগ্র। কাছাকাছি সময়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প অনুপমার প্রেম, আলো ও ছায়া, হরিচরণ, বোঝা ইত্যাদি রচিত হয়। বনেলী রাজ স্টেটে সেটলমেন্ট অফিসারের সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন এসময়। কিন্তু তারপরই বাবার উপর অভিমান করে সন্ন্যাসদলে যোগ দিয়ে গান ও নাটকে অভিনয়ে মনোনিবেশ করেন। কখনও কলকাতা হাইকোর্টের অনুবাদক, আবার বার্মা রেলওয়ের হিসাব দপ্তরের কেরানি হিসেবেও কাজ করেন শরৎচন্দ্র। রাজনীতিতেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ১৯২১ সালে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে, এবং হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে। এর মাঝে নিরন্তর চলেছে নিজস্ব জীবনবোধ ও অভিজ্ঞতা উৎসারিত সাহিত্যচর্চা। সমষ্টি আকারে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গল্প সমগ্র বিন্দুর ছেলে ও অন্যান্য, শ্রীকান্ত-৪ খন্ড, কাশীনাথ, ছেলেবেলার গল্প ইত্যাদি সময় নিয়ে প্রকাশিত হলেও পেয়েছিলো দারুণ পাঠকপ্রিয়তা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমূহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এবং বিশ্বব্যাপী পাঠকের কাছে হয়েছে সমাদৃত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমগ্র দেবদাস, শ্রীকান্ত, রামের সুমতি, দেনা-পাওনা, বিরাজবৌ ইত্যাদি থেকে বাংলাসহ ভারতীয় নানা ভাষায় নির্মিত হয়েছে অসাধারণ সফল সব চিত্রনাট্য ও চলচ্চিত্র। সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য এই খ্যাতিমান বাংলা সাহিত্যিক কুন্তলীন পুরস্কার, জগত্তারিণী স্বর্ণপদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি লাভ করেন। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।