‘সুবর্ণ-রাধিকা’ সাখাওয়াত হোসেন-এর প্রথম গল্পগ্রন্থ। গত চার বছরে (২৪-১০-২০২৩) লেখক যত গল্প লিখেছেন, সেখান থেকে পাঠক হিসেবে পড়ে যে গল্পগুলো সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে লেখকের নিজের, সেগুলোই এই বইয়ে জড়ো করা। বইয়ের মোট গল্প সংখ্যা একুশ। নির্দিষ্ট কোনো জনরা নেই, হিজিবিজি জনরায় ভর্তি। লভক্রাফটিয়ান হরর, অতিপ্রাকৃত, সাইকোলজিক্যাল, থ্রিলার কিংবা জীবনধর্মী। যারা গল্প পড়েননি, তাদের জন্য- গল্পগুলো সম্পর্কে কয়েক লাইন ধারণা দেওয়া যাক। 📖 ‘আদিম’ সন্তান অন্ধকার ভয় পায়, বদ্ধ ওয়াশরুম ভয় পায়। এক সন্ধ্যায় গলা চড়িয়ে ঝগড়া করায় অল্পবয়সীকে সন্তানকে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে লাইফ অফ করে দিলেন মা। সন্তান মুখোমুখি হলো অবর্ণনীয় এক ভয়ের। এই ভয়ের নাম, শূন্য। 📖 ‘প্রসূন’ হাসান ছোটোখাটো একটা চাকুরি করে, সংসারটাও ছোট তার। বউ ও একটা আট মাস বয়সী বাচ্চা। সমস্যাটা বাচ্চা। বাচ্চা ঘুমালে মাথার কাছে ফুল পড়ে থাকে তার। ছোট ছোট ফুল। সাদা রঙা। ছয়টা করে পাপড়ি। ফুলগুলোতে রসুনের গন্ধ। 📖 ‘গ্রন্থন’ স্বর্গ ও মানুষ। সব স্বর্গেই থাকে গন্দম বৃক্ষ। মানুষ তীব্র নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও ওই বৃক্ষের দিকে ছোটে। এই গল্পের একজনও ছুটেছিল। অজান্তে। অজ্ঞাতে। 📖 ‘বৃশ্চিক’ পুষ্প স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নগুলো স্বাভাবিক থাকে প্রথমদিকে। ফলে তার জানা হয় না, ওগুলো স্বপ্ন। একটু পরই স্বপ্নে মোড় আসে। ওই মোড়গুলো রক্তাক্ত। সর্বশেষ স্বপ্নে মা দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। মায়ের ঘাড়ের দিককার মাংস ছিল উধাও। 📖 ‘অপার্থিব’ তর্কসাপেক্ষে জগতের সবচেয়ে শক্তিশালী বিষের নাম অ্যাকোনাইট। ভদ্রলোক রোজ একটু একটু করে অ্যাকোনাইট খাচ্ছেন। পাকস্থলী বিষক্ষম করে তুলছেন। কেননা তার অনুমান, খুব শীঘ্রই তার বউ তাকে বিষ খাইয়ে হত্যা করবেন। 📖 ‘অন্তরকলন’ অন্তরকলন হচ্ছে গণিতের একটি শাখা, যেখানে একটি রাশির সাপেক্ষে অন্য রাশির পরিবর্তনের হার পরিমাপ করা হয়। অংকটা যদি ব্যক্তির ব্যক্তিগত হয়, তার অন্তরকলন সমাধান করবে কে? 📖 ‘বিভাস’ এক বৎসর এগার মাস তের দিন আগে ভদ্রলোক প্রেমে পড়েছিলেন। ভিনদেশী এক নারীর। নাম, মারিয়া। তাদের বিয়ে ঠিক হয়েছিল চব্বিশে এপ্রিল। বিয়ের দুই দিন আগে মারিয়া উধাও হয়েছেন। ভদ্রলোক খুঁজতে বের হয়েছেন তাকে। গন্তব্য তার জানা, যাওয়ার পথটা শুধু জানা নেই। 📖 ‘শালুক’ স্বামীর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে নারী। সঙ্গে কন্যা সন্তান। কন্যার নাম, তৃপ্তি। হঠাৎ একজন তৃতীয় নারীর আগমন। ওই নারী একটা চিঠি নিয়ে এসেছেন নারীর জন্য। চিঠিটা পড়া দরকার তার। 📖 ‘পারাবার’ ভার্সিটির ক্যাম্পাসের কোণায় একটা লাশ পাওয়া গেল। নগ্ন লাশ। মাথা থেকে কোমর অবধি মাটিতে পোঁতা। পা দু’টো উপরে শুধু, আসমানের দিকে তাক করা। পায়ের বুড়ো আঙুলে আটকানো কাগজে লাশের বয়স ও নাম ঝুলানো। লাশের নাম তওকীর। 📖 ‘অংশন’ গীর্জার কনফেশন রুমে একজন যুবক এসেছেন। উদ্দেশ্য কনফেস করা। কনফেসের গল্পটা শুরু হয় গ্রিক মিথোলজি দিয়ে। পৃথিবীর প্রথম নারী প্যান্ডোরাকে নিয়ে। যিনি শুধুমাত্র কৌতুহলের বশে একটা বাক্স খুলে ফেলেছিলেন। আর পৃথিবীকে উপহার দিয়েছিলেন ঘৃণা, হিংসা, লোভ, অসুখ অথবা মৃত্যু। 📖 ‘মোচক’ খোরশেদ আলম অনুভব করতে পারছেন, তিনি কুকুর হয়ে যাচ্ছেন। রুপক নয়, আক্ষরিক অর্থে কুকুর। আস্তে আস্তে প্রকাশ পাচ্ছে সব চিহ্ন। আজকাল গরম লাগে তার খুব, আর তখন তিনি প্রায়শই জিহ্বা বের করে বসে থাকেন। কুকুর কখনও ঘামায় না। ওরা উষ্ণতা বের করে জিহ্বা দিয়ে। 📖 ‘মন্দির’ পুকুরে মাছ হয় না ভালো। সংসারে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন। কর্তা একটা পশুবলী দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তখন। পুকুরপাড়ের ভগ্নমন্দিরে গোপনে বলী দেওয়া হবে কুচকুচে কালো রঙা একটা ছাগল। জোগাড়যন্ত্র হলো সব। মধ্যরাত্তিরে বলী দেওয়ার সময় সমস্যা হলো একটা। কোপানোর পর ছাগল দড়ি ছিড়ে পালালো, ঘাড়ে গাঁথা ছুরি নিয়ে। 📖 ‘ঘুম’ ঘুমপরীরা আসে স্বর্গের একটা বাগান হতে। ওরা যেচে আসে না কোনোদিন। ওদের ডেকে আনতে হয়। ওরা পৃথিবীতে নেমে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখে, কোথায় কোন ঘরে কার বাচ্চা ঘুমাচ্ছে না। ওদের হাতে থাকে একটা ম্যাজিক স্টিক। যখনই ওদের ডাকা হয়, ওরা ওই ঘরে পা রাখে, ওই বাচ্চার কপালে ম্যাজিক স্টিক ছুঁয়ে দেয় আলতো করে, আর বাচ্চা ঘুমিয়ে পড়ে। বাকিরা জেগে থাকে। বাকিদের ঘুম হয় না। বাকিদের ঘুম হয় না একশো বৎসর। 📖 ‘হাওয়া’ প্রত্যন্ত গ্রাম। রবিউল তখন কিশোর। এক রাত্তিরে মোষ আনতে গেল জঙ্গল থেকে সে। ফিরে এলো খালি হাতে। নগ্ন, মাথা এলোমেলো, ফ্যাকাসে চেহারা, উদভ্রান্ত দৃষ্টি। জানালো, ওর একজন সঙ্গী হয়েছে। ওই সঙ্গী তাকে ছেড়ে কোনোদিনও কোথায় যাবে না। 📖 ‘লা পেরেগ্রিনা’ নেক্সাসের এক গহীন জঙ্গলে এক যুবক কবর খুঁড়ছেন। নিজের কবর। তার হাতে একটা ম্যাপল পাতা। গলায় মুক্তা আর সঙ্গে একখানা গল্প। ওই গল্প পাঁচশো বৎসর পুরনো। 📖 ‘অন্বয়’ অক্সালিস ট্রায়াঙ্গুলারিস হলো পাতাবাহার জাতীয় একধরণের উদ্ভিদ। অন্যান্য ফুলগাছের ফুল সুন্দর, অক্সালিসের পাতা সুন্দর। হার্ট শেইপ। এক ডাঁটে তিনটা করে পাতা। প্রজাপতির মতোন। বড়ই অভিমানী এই গাছ। অল্প একটু অবহেলায়ও মরে যায়। বলা হয়, সব মানুষের হাতে অক্সালিসের ফুল হয় না। শুধুমাত্র যারা সৌভাগ্যবান, তাদের গাছে ফুল হয়। প্রশ্ন হলো, হাতে অক্সালিস নিয়ে ফুল ফোটার জন্য একটা মানুষকে কতকাল অপেক্ষা করতে হয়? কতদূর যেতে হয়? 📖 ‘নবমী’ ড্যান একটা বাসায় পা রেখেছেন। মধ্যরাত। তার উদ্দেশ্য চুরি করা। চুরি করে সহজেই ভেগে যাওয়ার সুযোগ থাকার পরও বেডরুমের দরজার দু’টো ফুটো আটকালো তাকে। কৌতুহলের বশে ফুটোয় চোখ রাখলেন ড্যান। এবং তার সর্বনাশ হলো। 📖 ‘দাহ’ বাবার বয়স হয়েছে। ভীষণ অসুস্থ তিনি। পুত্র সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে বাবাকে বাঁচিয়ে রাখার। ওই বাঁচিয়ে রাখার পেছনের কারণ স্বাভাবিক নয়। বাবা একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। ওই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগ অবধি তার মৃত্যু নেই। 📖 ‘জননী’ একটা বদ্ধ লিফট। দু’জন মাত্র মানুষ। একজন কিশোরী, অন্যজন মা। দুইজনের মধ্যে সম্পর্কটা স্বাভাবিক নয়, জটিল। বদ্ধ জায়গায় কিশোরী ঠিকঠাক, মা নন। কেননা মায়ের আছে একটা অসুখ। ক্লস্ট্রোফোবিয়া। লিফট ঠিক হতে সময় নেবে পনের মিনিট। গত চার বৎসরে যতগুলো গল্প লিখেছি, সবচেয়ে বেশী তৃপ্তি পেয়েছি এই গল্পের শেষ লাইন লিখে। এই গল্প ডায়েরীর খুব পছন্দ। 📖 ‘অর্বুদ’ জেনিফারের বয়স যখন দশ বৎসর, তার বাবা মা চূড়ান্ত ঝগড়া করলেন একদিন। একই ছাদের তলায় দুইজন আলাদা হয়ে গেলেন। দুইজনের জিনিসপত্র আলাদা হয়ে গেল। কিন্তু জেনিফার তাদের একমাত্র সন্তান হওয়ায়, তারা পড়লেন বিপাকে। যতবড়ো ঝামেলা, তত সহজ সমাধান। ওই সকালবেলায় বাহির থেকে কাঠ কাটার করাত নিয়ে আসলেন তারা। জেনিফারকে ঠিক মাঝখান বরাবর কাটা হবে। 📖 ‘সুবর্ণ-রাধিকা’ রাধিকা সদ্য মা হয়েছেন। রাধিকার স্বামীর নাম সুবর্ণ। ওদের বাচ্চার বয়স মাত্র পাঁচ দিন। রাধিকা বাচ্চার নাম কী রাখবেন ভেবে দিশা পাচ্ছেন না। এমন একটা নাম দরকার, যে নামটা হবে তীব্র অথচ কোমল। ধারালো আবার স্নিগ্ধও। রাধিকা বাচ্চাটার নাম রাখতে পারলেন না। কেননা হসপিটাল থেকে ফেরার পর ছয়দিনের মাথায় বাচ্চাটা রেলিং থেকে নিচে পড়ে থেঁতলে মারা গেল। রাধিকা জানেন বাচ্চাকে উপর থেকে নিচে ফেলে দিয়েছে কে। কিন্তু তার হাতে কোনো প্রমাণ নেই।