ভূমিকা আমার জীবদ্দশায় গ্রন্থটি প্রকাশিত হবে এ আশা করিনি। রচনা শুরু করি ১৯৬১ সালের ১ নভেম্বর তারিখে। রচনা সমাপ্ত হয় ১৯৬৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশের ওপর নির্যাতনের কঠোরতা তখন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনের পর কিঞ্চিৎ আশান্বিত হই। জৈনক খ্যাতমান প্রকাশক সংশোধিত পাণ্ডুলিপির প্রায় অর্ধাংশ নিয়েও যান। কিন্তু তিনি মুদ্রণ আরম্ভ করার পূর্বেই নেমে এলো ২৫ মার্চের ভয়াবহ রাত্রি। প্রকাশক ভদ্রলোক প্রাণ-রক্ষার্থে ভারতে চলে যান, তার প্রতিষ্ঠানও বিশেষ ভাবে ক্ষতি গস্ত হয়। মূল পাণ্ডুলিপি নিয়ে আমি নিজেও ঢাকা ত্যাগ করি। এবং গ্রামের বাড়িতে মাটির নিচে লুকিয়ে রাখি। ১৯৭১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর তারিখে আমি ৮ ঘণ্টাকাল ক্যান্টনমেন্টে নির্যাতিত হই। বলাবাহুল্য,দেশ স্বাধীন হওয়ার ফলেই আমার জীবদ্দশায় পদ্ম মেঘনা যমুনা প্রকাশিত হলো। স্বাধীনতার সংগ্রামে আমার দেশের লক্ষ লক্ষ নর-নারী প্রাণ দিয়েছেন। শ্রদ্ধাভরে তাঁদের স্মরণ করছি। ভাওয়াল গড়ের উপখ্যান -এর ভূমিকায় যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম এই প্রকাশের সাথে তা প্রায় পালিত হলো বলতে পারি। প্রতিশ্রুতি আরো একটি ছোট কাজ। সেটিও প্রকাশিত হওয়ার পথে। এই গ্রন্থ মুদ্রণকালে আমার অকৃত্রিম বন্ধু ও শুভাকাঙ্খী সাহিত্যকর্মী শওকত ওসমানের কাছ থেকে উৎসাহিত পেয়েছি। অনুপ্রতিম খায়রুল কবিরের কাছ থেকে আমি নানাভাবে কৃতজ্ঞ। বর্ণমিছিল এর স্বত্বাধিকারী জনাব তাজুল ইসলাম যে দরদ দেখিয়েছেন তা আমার কাছে অপরিশোধ্য ঋণ। মামুলি ধন্যবাদ তার মোকাবিলা সম্ভব নয়। পরিশেষে গ্রন্থের বিষয়বস্তু সম্বন্ধে দু’চারটি কথা। কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা এবং ব্যক্তি ব্যতীত গ্রন্থের বাকি সমস্ত চরিত্র কাল্পনিক। ঐতিহাসিক ঘটনাবলির কালানুক্রমে সবক্ষেত্রে রক্ষিত হয়নি। উপন্যাসে তার আবশ্যকতাও নেই। পুস্তকের প্রথম পর্যায়ে ঢাকা সদর উত্তর মহকুমায় প্রচলিত কিছু আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আশা করি, সেগুলো পাঠক বুঝে নিতে পারবেন। -আবু জাফর শামসুদ্দীন
সূচিপত্র * প্রথম খণ্ড: উন্মেষ * দ্বিতীয় খণ্ড: উদঘূর্ণা * তৃতীয় খণ্ড: মহানগরী * চতুর্থ খণ্ড: ঝড় * পঞ্চম খণ্ড: উলঙ্গ আদম
আবু জাফর শামসুদ্দীন বাংলা ১৩১৭ সালের ২৮ ফাল্গুন (মার্চ, ১৯১১) তৎকালীন ঢাকা জেলার কালীগঞ্জ থানার দক্ষিণবাগ গ্রামে এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩২ সালে তাঁর সাহিত্য জীবনের শুরু। তিনি অসংখ্য গল্প, বেশকিছুসংখ্যক উপন্যাস, নাটক, মননশীল প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনী প্রভৃতি রচনা করেছেন। তাঁর রচিত এবং প্রকাশিত পুস্তকের সংখ্যা তিরিশটির অধিক। তাঁর হাজার পৃষ্ঠার সুবৃহৎ উপন্যাস 'পদ্মা মেঘনা যমুনা' বাংলা সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। উভয় বাংলায় এ-গ্রন্থ উচ্চ প্রশংসা অর্জন করে। আবু জাফর শামসুদ্দীনের গল্প ইংরেজি, জাপানি, হিন্দি, উর্দু, মারাঠি প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে। উপমহাদেশের একজন প্রথম সারির সাংবাদিক এবং কলামিস্ট হিসেবে তাঁর খ্যাতি রয়েছে। ১৯৭৫ সাল থেকে দৈনিক 'সংবাদ'-এ 'অল্পদর্শী' এই ছদ্মনামে 'বৈহাসিকের পার্শ্বচিন্তা' শীর্ষক কলাম মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত নিয়মিত লিখে গেছেন। সাহিত্য এবং সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বিশিষ্ট অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক, বেগম জেবুন্নিসা-কাজী মাহবুবুল্লাহ স্বর্ণপদক, জহুর হোসেন চৌধুরী স্মৃতি স্বর্ণপদক, সমকাল সাহিত্য পুরস্কার, মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার, ফিলিপস পুরস্কার (মরণোত্তর) প্রভৃতি লাভ করেন। তিনি সৃজনশীল লেখার পাশাপাশি মানব মুক্তি ও বিশ্ব শান্তির আদর্শে বিশ্বাসী বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন। বাংলা ১৩৯৫ সালের ৭ ভাদ্র (২৪ আগস্ট ১৯৮৮) তিনি পরলোক গমন করেন।