এই বইটির লেখা ও প্রকাশনায় যাদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি, তারা আমার পরিবারের ছোট সদস্যরা। আমার দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ও আবেগপূর্ণ অনুভূতি ব্যক্ত করার মানসে আমার স্বর্গীয়া স্ত্রী কল্যাণী ভৌমিককে নিয়ে কিছু একটা লেখার অভিপ্রায় ছিল মাত্র। কিন্তু আমার সেই ক্ষুদে পড়ুয়া নাতি-নাতনীরা এটা পড়ে ভীষণ বিপাকে ফেলে দেয় আমাকে। মুক্তিযুদ্ধ ও আমার অতীত জীবন সম্পর্কে আমাকে লিখতেই হবে। কিছু লেখালেখির পর আমার সাহিত্যমনষ্ক জ্যেষ্ঠ ছেলে দেবু আমাকে বলল আরও কিছু লিখতে- যাতে একটি পুস্তক আকারে প্রকাশ করা যায়। বইটির সূচনা পরিবারমুখী হলেও এতে বহু অবলুপ্তপ্রায় স্মৃতি উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে- যা বর্তমান প্রজন্মকে অনেক তথ্য পরিবেশন করবে। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালির অবদান, তৎকালীন মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থান থেকে উন্নয়নের প্রেক্ষাপট পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। বইটিতে ধারাবাহিকতার অভাব থাকলেও বৈচিত্রের ঘাটতি আছে বলে আমার মনে হয় না। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের জন্য কিছু বার্তা রয়েছে এই বইয়ে। রয়েছে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কীভাবে একটি বৃহৎ গণ্ডিকে শিক্ষা ও উন্নয়নে ভরে দিতে পারে তার প্রতিচ্ছবি। বিশ্বজন স্বীকৃত কিছু মানবিক কর্মকাণ্ডের প্রতি বর্তমান সমাজের দায়িত্ববোধকে সজাগ করার নির্দেশনা দেওয়ারও চেষ্টা করেছি। বইটি যদি পাঠককের মননে নতুন বোধের উন্মেষ ঘটায় তবেই আমার এই প্রচেষ্টা ও শ্রম সার্থক হবে।
জন্ম ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার মীরসরাই উপজেলার হিঙ্গুলী গ্রামে। পিতা মহেন্দ্র কুমার ভৌমিক, মাতা শান্তিময়ী ভৌমিক ও ছোট ভাই মানিক লাল। ভৌমিক। মাত্র ৫ বছর বয়সে তিনি তাঁর পিতাকে হারান। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হিঙ্গুলী গনকছড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কিশোরকালে চলে আসেন মাতুলালয় মলিয়াইশে। সেখানেই তিনি বেড়ে ওঠেন। মিঠানালা রামদয়াল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন, ফেনী সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট ও বিকম পাশ করেন। পরবর্তীতে বিএড ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। স্নাতক পরীক্ষা দেয়ার পরপরই যোগ দেন শিক্ষকতায় মিঠানালা রামদয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ে। তরুণ শিক্ষক হিসাবে খুব অল্প সময়ে তিনি সবার নজর কাড়েন। বিশিষ্টজনদের অনুরোধে বাড়ির সামনের মলিয়াইশ জুনিয়র স্কুলে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেন। মেধা ও শ্রম দিয়ে তিনি ওই জীর্ণ স্কুলটিকে একটি সমৃদ্ধ উচ্চ বিদ্যালয়ে উন্নীত করেন। একনাগাড়ে ৩৬ বছর প্রধান। শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করার পর ২০০০ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি এলাকার রাস্তাঘাট-ব্রিজ নির্মাণ, পোস্ট অফিস স্থাপন, বিরোধ মীমাংসাসহ বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমের সাথে জড়িত ছিলেন। প্রিয় ছাত্রদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তিনি। এক কথায় দিলীপ রঞ্জন ভৌমিকের আলোয় আলোকিত হয়েছে এ অঞ্চল। আজও তিনি পঠন-পাঠন, সৃজনশীল ভাবনা ও লেখালেখিতে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন। তাঁর প্রত্যাশা একটি সুস্থ, রুচিবোধসম্পন্ন সমাজ, একটি আলোকিত বাংলাদেশ।