বাংলাসাহিত্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অতুল জনপ্রিয় এক কথাসাহিত্যিক। প্রায় শত বছর থেকে তাঁর তুমুল জনপ্রিয়তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলো বাংলাসাহিত্যের পাঠকের পাঠসূচিতে অবশ্যপাঠ্য হিসেবে স্থান পেয়েছে। মূলত উপন্যাস এবং গল্প লিখে অমর হয়ে আছেন এই কথাশিল্পী। তাঁর কালজয়ী সাহিত্যকর্মের কয়েকটি অবলম্বনে ভারত উপমহাদেশে বিভিন্ন ভাষার নির্মিত হয়েছে পঞ্চাশটি চলচ্চিত্র। বাংলা, হিন্দি, তেলেগু ভাষায় আটটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে কেবল দেবদাস উপন্যাস অবলম্বনে। শরৎচন্দ্র শিশু-কিশোরদের জন্য গল্পও লিখেছেন অনেক। এ বিষয়ে তাঁর বয়ান—এর আগে তোমাদের জন্যে কখনো লিখিনি। যাঁরা তোমাদের প্রিয় লেখক, তাঁদের মুখে শুনি তোমাদের খুশি করা বড় শক্ত। অথচ সম্পাদকরা অনুরোধ করেছেন কয়টি গল্প লিখে দিতে। এ যেন কুমোরের কাছে কুড়ল গড়বার ফরমাস। এই বিপদে হঠাৎ মনে পড়ল এক বাল্য-বন্ধুর কথা। ভাবলাম আজ তারই দু-একটা গল্প বলি। শুনে খুশি হও, —ভালোই।’ লালু ও অন্যান্য গল্প গ্রন্থে শরৎচন্দ্রের এরকম কয়েকটি অসাধারণ গল্প সংকলিত হয়েছে। নিঃসন্দেহে বলা যায়, শিশু-কিশোর পাঠকের জন্য গ্রন্থটি হবে একটি আনন্দের পাঠ।
বাঙালির জীবনের আনন্দ-বেদনাকে সাবলীল স্বচ্ছন্দ ভাষায় যে কথাশিল্পী পরম সহানুভূতি ভরে তুলে ধরেছেন বাংলা সাহিত্যে, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৭৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, হুগলি জেলার ছোট্ট গ্রাম দেবানন্দপুরে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শরৎচন্দ্র। দারিদ্র্যের কারণে তাঁর শৈশবকাল বলতে গেলে মাতুলালয় ভাগলপুরেই কেটেছে। দারিদ্র্যের কারণে ফি দিতে না পেরে বেশ কয়েকবার স্কুল বদলিও করতে হয়েছিলো ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত ও মেধাবী শরৎচন্দ্রের। এন্ট্রান্স পাস করে কলেজে ভর্তি হলেও এফএ পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে না পেরে পরীক্ষায় বসতে পারেননি। দারিদ্র্য যখন শিক্ষাজীবনে অব্যহতি টানলো, তারপরই শুরু হলো আপাত সাধারণ এই মানুষটির বর্ণাঢ্য কর্ম ও সাহিত্যজীবন। এ সময় প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্টের বাড়িতে আয়োজিত সাহিত্যসভায় লেখালেখির অনুপ্রেরণা ফিরে পেলেন যেন আবার। যার ফলশ্রুতিতে বাংলা সাহিত্য পেয়েছিলো বড়দিদি, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা’র মতো কালোত্তীর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর উপন্যাস সমগ্র। কাছাকাছি সময়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প অনুপমার প্রেম, আলো ও ছায়া, হরিচরণ, বোঝা ইত্যাদি রচিত হয়। বনেলী রাজ স্টেটে সেটলমেন্ট অফিসারের সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন এসময়। কিন্তু তারপরই বাবার উপর অভিমান করে সন্ন্যাসদলে যোগ দিয়ে গান ও নাটকে অভিনয়ে মনোনিবেশ করেন। কখনও কলকাতা হাইকোর্টের অনুবাদক, আবার বার্মা রেলওয়ের হিসাব দপ্তরের কেরানি হিসেবেও কাজ করেন শরৎচন্দ্র। রাজনীতিতেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ১৯২১ সালে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে, এবং হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে। এর মাঝে নিরন্তর চলেছে নিজস্ব জীবনবোধ ও অভিজ্ঞতা উৎসারিত সাহিত্যচর্চা। সমষ্টি আকারে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গল্প সমগ্র বিন্দুর ছেলে ও অন্যান্য, শ্রীকান্ত-৪ খন্ড, কাশীনাথ, ছেলেবেলার গল্প ইত্যাদি সময় নিয়ে প্রকাশিত হলেও পেয়েছিলো দারুণ পাঠকপ্রিয়তা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমূহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এবং বিশ্বব্যাপী পাঠকের কাছে হয়েছে সমাদৃত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমগ্র দেবদাস, শ্রীকান্ত, রামের সুমতি, দেনা-পাওনা, বিরাজবৌ ইত্যাদি থেকে বাংলাসহ ভারতীয় নানা ভাষায় নির্মিত হয়েছে অসাধারণ সফল সব চিত্রনাট্য ও চলচ্চিত্র। সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য এই খ্যাতিমান বাংলা সাহিত্যিক কুন্তলীন পুরস্কার, জগত্তারিণী স্বর্ণপদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি লাভ করেন। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।