ঘুম থেকে উঠতে আমাকে কোনোদিনই ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে রাখতে হয়নি। ভোর, সন্ধ্যা, মাঝরাত যখনই আমার ওঠার প্রয়োজন হতো সময়টা মনে রেখে আমি ঘুমিয়ে যেতাম এবং ঠিক সময়ই আমার ঘুম ভেঙে যেত। প্রতিদিন ভোর ৫ টায় ওঠা আমার অভ্যেস। যত রাতেই ঘুমাই না কেন রাত ১২টা, ১টা, ২টা। সকাল পাঁচটায় ঘুম ভেঙে যাবে। আর ঘুম আসবে না। আমি সকালে বিছানায় ঘুমাতে পারি না। রুটিনটা অনেকের সাথেই মিলে না। চিন্তা করি আমার এই অভ্যেসটা কেমন করে হলো। সম্ভবত আমার জীবনের প্রথম চাকরিটাই সেটা সেট করে দিয়েছে। এখন আমি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। কিন্তু ভোরে ওঠার অভ্যেসটা অবসর নেয়নি। ভোর সকালে ওঠে প্রস্তুত হয়ে অফিসে যাব সেই তাড়া নাই। কিন্তু ভোরে ওঠার তাড়া অভ্যাস রয়েই গেছে। পঁয়ষট্টি বৎসরে এসে চিরাচরিত রুটিন হঠাৎ থেমে গেল। ভোর পাঁচটায় উঠে বেগম সাহেবাকে ডেকে উঠিয়ে নিয়ে হাত মুখ ধোয়া, শেভ, গোসল, অজু নামাজ সারতে সারতে ততক্ষণে বেগম সাহেব কাজের মেয়েদের ডেকে তুলে সকালের নাস্তা, বাচ্চাদের টিফিনের বন্দোবস্তে নেমে গেছেন। ছেলেমেয়ে আছে ঘুমেÑ ওদের টেনেহ্যাঁচড়ে ওঠানোর এক প্রাণান্ত চেষ্টা। আমি রেডি হয়ে টেবিলে আসতে আসতে নাস্তা রেডি, গোগ্রাসে নাস্তা গিলে গাড়িতে উঠতেই ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিল। সেই একই রুটিনে আমার কর্মজীবন চলছিল। গন্তব্য ইপিজেডের ইয়াং ওয়ান, লগনী ফ্যাশন, সোনারগাঁ হোটেল, আহসানিয়া মিশন আর সবশেষে বনানীতে সোসিয়্যাল মার্কেটিং কোম্পানি (ঝগঈ)। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল আমার প্রথম চাকুরি। আমার প্রথম চাকুরি ছিল জেমস ফিনলে টি গার্ডেনে যার সবটাই ছিল সিলেটের ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন জেলায়। প্রথম চাকরির ইতিহাসে, যার ব্যাপ্তি ছিল প্রায় চৌদ্দ বৎসর, আমি পরে আসছি। উপরের এতগুলো দেশি-বিদেশি কোম্পানি মানব সম্পদের প্রধান হিসাবে উল্কার মতো সময়ের সাথে ছুটে চলেছি। এইচআর প্রধান আমি কোম্পানির প্রতিটি কর্মকর্তা, কর্মচারী পরিচালনার জট মাথায় নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। কোথাও কর্মকর্তা কর্মচারী পাঁচশত/সাতশত, কোথায়ও সাত হাজার/দশ হাজার। সবার চাকরির প্রথম থেকে শেষ হওয়া পর্যন্ত ছিল আমার দায়িত্ব। তাদের দেখাশুনা ছিল আমার কর্তব্য। তাদের স্বাদ আহলাদ সুখ-দুঃখের সাথে মিশে যাওয়া ছিল আমার জীবন। সেটা ছিল এক যুদ্ধক্ষেত্রের ইতিহাস। আজ সবই অতীত সবই গতকালের সংবাদপত্রের মতো ফেলে আসা এক টুকরো স্মৃতি। আমার গতকালের ফেলে আসা জীবন কি আমার অফুরন্ত অবসরের কাছে এক বিস্বাদ কাহিনি? সেই সাতসকাল ৫ ঘটিকায় আগের মতো ঘুম থেকে উঠছি কিন্তু নেই কোনো তাড়া অফিসে যাবার। মাথার ভিতর নেই অফিসের জট পাকানো চিন্তা। জীবনটা যেন হঠাৎ ফার্স্ট ফরওয়ার্ড থেকে হয়ে গেছে ¯েøা মোশন। কোনো ব্যস্ততা নেই, নেই কর্মজীবনের উল্কার মতো ছুটে চলা। নেই শুধু এগিয়ে যাওয়ার প্রতিদ্ব›িদ্বতা। কিন্তু এই অশান্ত বেগের পরিবর্তে এখন আছে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি। শেষ জীবনে এসে নতুন করে জীবনকে আবিষ্কার করা। প্রথম প্রথম মনে হতো এই অবসর জীবন যেন মিস্টিরস নিংড়ানো এক টুকরো আখ। স্বাদহীন, রসহীন শুধু ছোবড়া। ভোর পাঁচটা, স্বাভাবিকভাবেই ঘুম থেকে উঠে ওজু করে ফজরের নামাজ আদায় করলাম। এই সময় আমি নামাজ পড়ার জায়গার পাশের পর্দাগুলো সরিয়ে দেই আলোর জন্য, কোনো লাইট জ্বালাই না। অন্ধকার থেকে আস্তে আস্তে আলোর ফুটার যে রূপ সেই অপার সৌন্দর্য আমি কোনোদিন অনুভব করিনি। জীবনের তাড়ায় এর কোনো দাম ছিল না। ভোরের পাখির কলতান অনুভব করার চেষ্টা করি। চিন্তা করি অন্ধকার থাকতে এই পাখিগুলোতো ডাকাডাকি করেনি। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে তারাও জীবন সংগ্রামের জন্য আরেকটি দিনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কোরআন থেকে জেনেছি এই ভোরে ফেরেশতাদের পালাবদলের সময়Ñ একঝাঁক ফেরেশতা আকাশের দিকে উড়ে যায় আরেক ঝাঁক পৃথিবীতে তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়। পাখিরা বিশেষ করে তাদেরকে নাকি দেখতে পায়। তাই পক্ষীকুল সেই সাতসকালে আগাম জানিয়ে দেয় ফেরেশতা আসার বার্তা।