প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে ১৯২১ সালে। বর্তমানে যার বয়স শত বছর পেরিয়েছে। এই সুদীর্ঘ দিনের ইতিহাসে যে ছাত্রীটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ডাকসু-এর ভিপি নির্বাচিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন তিনি মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার পারিলের সন্তান অধ্যাপক মাহফুজা খানম। প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিক ম্যাজিস্ট্রেট মতিয়র রহমান খান তাঁর দাদা, দেশের বীমা আন্দোলনের অগ্রপথিক ও বৃটিশ-বিরোধী বিপ্লবী মুস্তাফিজুর রহমান খান তাঁর বাবা এবং বিশিষ্ট সমাজসেবক সালেহা খানম তাঁর মাতা। মাহফুজা খানম সমাজতান্ত্রিক আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে ছাত্রজীবনে ১৯৬২ সালে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত হন। ১৯৬৬-৬৭ সালে তিনি ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন। এ সময়টা ছিল ১৯৬৯ সালের ছাত্র-গণ আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্ব। এই সময় তিনি ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি অন্যান্য আন্দোলনেও অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। যেমন, কৃষক-শ্রমিক আন্দোলন ও নার্সদের আন্দোলন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ, টিভি টাওয়ার ও ইউএসআইএস লাইব্রেরিতে বিশেষ অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রয়েছে তাঁর কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা। মাহফুজা খানম ১৯৬৭ শিক্ষাবর্ষে পদার্থবিদ্যায় অনার্সসহ প্রথম শ্রেণিতে এম.এসসি. ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি প্রথম মহিলা যিনি আণবিক শক্তি কমিশনে থিসিস করেন। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি কলেজ শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি কর্মজীবনে বেশ কয়েকটি সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে মানিকগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন ২০০৩ সালে। একজন নারীনেত্রী হিসেবে তিনি মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যকরী সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি দেশের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংগঠনে ২০টি ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি ১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১টি এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেছেন। মাহফুজা খানম ‘বিশ্ব শিক্ষক ফেডারেশন’-এর (১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত) সর্বপ্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। তিনি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অন্যতম সদস্য। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য। তিনি শিশু কিশোর সংগঠন খেলাঘরের চেয়ারপার্সন। তিনি মানিকগঞ্জ জেলা সমিতির (১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত) প্রথম নারী সভাপতি। তিনি চেয়ারম্যান কলেজ পরিচালনা পরিষদ ড. মালেকা কলেজ ও ন্যাশনাল কলেজ অব হোম ইকোনমিক্স। তিনি পরিচালনা পরিষদ সদস্য জাতীয় যাদুঘর ও জাতীয় শিল্পকলা একাডেমী। তিনি নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয়-এর বোর্ড-অব-ট্রাস্টি সদস্য ও সিন্ডিকেট সদস্য। তিনি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি-এর (১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত) দুই টার্ম (চার বছর) করে সাধারণ সম্পাদক, সম্পাদক, সহ-সভাপতি এবং সর্বপ্রথম নারী সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। মাহফুজা খানম ‘মাসিক খেলাঘর’ সন্দেশের উপদেষ্টা সম্পাদক ও বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকা ‘টেলিস্কোপ’-এর প্রধান সম্পাদক। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রকাশনার মধ্যে রয়েছে গণমানুষের মুক্তি আন্দোলন’-২খন্ডে, ‘মধুদা’, ‘লীলানাগ’ ও ‘মুস্তাফিজুর রহমান খান স্মারকগ্রন্থ’। তাঁর ব্যক্তিগত দিনলিপি ধারাবাহিক ভাবে ‘মাহফুজা খানমের ডায়েরি’-৭খন্ড এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে। মাহফুজা খানম শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা হতে অসংখ্য পুরষ্কার লাভ করেন। পদকের মধ্যে রয়েছে ‘একুশে পদক-২০২১’, ‘বেগম রোকেয়া পদক-২০১২’, ‘অনন্যা শীর্ষ দশ-২০১৩’, ‘মাদার তেরেসা গোল্ড মেডেল’ (২০১০ ও ২০১১), ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সম্মাননা পদক-২০১০’, ‘মহাত্মা গান্ধী পিস অ্যাওয়ার্ড-২০১০’ ইত্যাদি। মাহফুজা খানম ১৯৬৯ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর স্বামী প্রক্ষাত আইনজীবী ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্তন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। তাঁদের জ্যেষ্ঠ পুত্র ডা. মাহফুজ শফিক, কন্যা ডা. মাসরুরা শফিক এবং কনিষ্ঠ পুত্র ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক। তাঁদের নাতী-নাতনীর সংখ্যা ৬ জন।