পরম করুণাময়ের অশেষ কৃপায় আমার সহকর্মী মো: গোলাম রসুল সাহেব কাব্যগ্রন্থ "রূপ সাগরের মাঝি" শিরোনামে লিখতে সক্ষম হয়েছেন। ** নিজের কথা, পরের কথা এবং বাহ্যিক জগতের কথা যখন একজন লেখকের মনোবীণায় সুর ঝংকৃত হয় তখন সাহিত্যের সৃষ্টি হয়।" সাহিত্য বলতে আমরা সেই রচনা কে স্বীকৃতি দেই, যা জীবন প্রবাহের বিচিত্র ও জটিল অভিজ্ঞতা সমূহ কে মন্থন করে কোন "বিশেষ সৃজন' রূপে যার সৃষ্টি বা উদ্ভব। ** কবিহৃদয়ের গুঞ্জরিত ভাবের সুরময় প্রকাশই কবিতা। উৎকৃষ্ট ভাবের উৎকৃষ্ট শব্দ বিন্যাসই কবিতা। আর কতগুলো কবিতার সমন্বয়ে একটি কাব্যের সৃষ্টি হয়। তেমনি একটি কাব্যগ্রন্থ "রূপ সাগরের মাঝি'। আমরা বলতে পারি যে কবির বেদনাবিদ্ধ হৃদয়ই কবিতার জন্মভূমি অর্থাৎ সময় বিশেষে কোন একটি বিশেষ সুত্রকে অবলম্বন করে কবির আনন্দ বেদনা যখন প্রকাশের পথ পায় তখনই কবিতার জন্ম। ** আধুনিক যুগের সুত্রপাতের সঙ্গে সঙ্গে সুদীর্ঘ দিনের ঐতিহ্যময় বাংলা কাব্য ধারার আমুল পরিবর্তন সাধিত হয় এবং পাশ্চাত্য আদর্শ প্রভাবিত নুতন কবিতা ধারার উন্মেষ ঘটে। বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের বৈচিত্র্যময় সাহিত্য সৃষ্টি ইংরেজি সাহিত্যের প্রত্যক্ষ প্রভাবের ফল। মধ্যযুগের ধ্যান ধারণা থেকে অব্যাহতির লাভের সুযোগ ইংরেজদের আগমনে ইংরেজি শিক্ষার প্রভাব বাঙালীদের পক্ষে লাভ করা সম্ভব হয়েছিল। জাতীয় জীবনে তখন যে ব্যপক পরিবর্তন সাধিত হয় সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তার স্পর্শ লাগে এবং বাংলা সাহিত্যে নবযুগের সূচনা হয়। আধুনিক যুগের সীমানায় প্রথম কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কিন্তু তাঁর মধ্যে আধুনিকতার কিছুটা বৈশিষ্ট্য থাকলেও তিনি মধ্যযুগীয় বৈশিষ্ট্য কাটিয়ে উঠতে পারেননি। পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রভাবে বাংলা সাহিত্যের যে কালান্তর ঘটেছিল তার সগৌরব উপস্থিতি ঘটেছে আরও কিছুটা পরে। পরবর্তীতে কবি রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায় আধুনিকতার পরিচয় সৃষ্টি করে তুললেও তাঁর কাব্যে নুতন যুগের বানীর পরিপূর্ণ বিকাশ লক্ষণীয় নয়। এ ধরনের প্রাথমিক প্রচেষ্টায় আধুনিকতার আভাস তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছিল। বস্ততপক্ষে পাশ্চাত্য প্রভাব সম্প্রসারণের জন্য কিছুটা সময়ের প্রয়োজন ছিল এবং সে কারণেই আধুনিকতার যথার্থ বিকাশ বিলম্বিত হয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্তের আমল থেকেই লক্ষনীয় হয়ে উঠে। তাই নবীন কবিতার পরিধি ঈশ্বর গুপ্ত থেকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত পর্যন্ত সম্প্রসারিত। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ যে, বাংলা সাহিত্যের এই আধুনিক যুগেই কাব্য রচনা বৈচিত্র্যধর্মী হয়ে উঠেছিল। এই সৃষ্টি বৈচিত্র আধুনিকতার অন্যতম লক্ষ্মণ। আঙ্গিক ও বিষয় বৈচিত্র্যের দিক থেকে কবিতা কে মন্ময় বা গীতি কবিতা ও তন্ময় বা বস্তুনিষ্ঠ কবিতা এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা যেতে পারে। মন্ময় বা গীতি কবিতাকে ভক্তিমূলক, স্বদেশপ্রীতিমূলক, চিন্তামূলক, প্রেমমূলক, শোক বিষয়ক, প্রকৃতি বিষয়ক, সনেট, লঘুবৈঠকি, স্তোত্র ইত্যাদি উপবিভাগে ভাগ করা যায়। অন্যদিকে তন্ময় বা বস্তুনিষ্ঠ কবিতা কে গাথা কবিতা, মহাকাব্য, নীতি কবিতা, রূপক কবিতা, ব্যাঙ্গকবিতা, লিপি কবিতা ইত্যাদি ভাগে ভাগ করা যায়। গদ্য কবিতা সৃষ্টি হয়েছে ছন্দের বিচিত্র পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে এবং উপজীব্য বিষয়ের বৈচিত্র। আধুনিক বাংলা কাব্য ধারা এইসব বিচিত্র আঙ্গিকের পরিচয় বহন করে। ** কাব্য পাঠের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কাব্য বা কবিতায় আমরা সাধারণত বাহ্যজগত ও মানব জীবনের কাহিনী এবং ভাব-কল্পনা সুন্দর ও মনোরম করে পাই। কবিতা ভাবকে রূপে পরিবর্তন করে। "ভাব' হতে" রূপে 'অভিরাম যাওয়া আসার তত্ত্বই কবিতায় প্রকাশিত। যা অদেহী বা অপরূপ, সূক্ষ্ম বা ইন্দ্রিয়াতীত, কবি তাকে দেহ, রূপ ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য মূর্তিদান করেন। কবিতার চিরন্তন আবেদন আমাদের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যবোধের কাছে। তা ভাব সঞ্চারী বলে আমাদের মনে বিচিত্রময় উদ্দীপন করে। বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক বিচারের যে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেন তা অসুন্দর হলেও সত্য। কিন্তু কবি কল্পনা বলে যে সত্য আবিষ্কার করেন তা সুন্দর হতে বাধ্য। ** কবিতার একটি বিশেষত্ব কবিতায় ব্যবহৃত ছন্দ। তবে এছন্দ বলতে অন্তমিল সম্পন্নতাকে বোঝায় না। কবিতার ছন্দ এক ধরনের Rhythm বা ছন্দ স্পন্দন যাকে কবিতার ভাষায় সঙ্গীতধর্ম বলা যেতে পারে। এ ছন্দ স্পন্দনে থাকে তাল লয়ের সৌন্দর্য সুষমা যা কবিতায় আবেগী, কল্পনা আশ্রয়ীভাব প্রকাশের উপযোগী। জীবনের সুখ দু:খ, পাপ পুন্য,ধর্ম,অর্থ, মোহ, কাম,প্রভৃতি যে কোন বিষয়ই কাব্যের উপাদান অঙ্গ হিসেবে গৃহীত হতে পারে। তবে সে সব উপাদান জীবন থেকেই গ্রহণ করা হয়। কাব্যের সাথে পৃথিবীর, জীবন , মানব ও প্রকৃতির সম্পর্ক সুনিবিড়। জীবনের মূহুর্তে সংঘটিত দু:খ,আনন্দ, বেদনা বা যাবতীয় কিছুর আত্মোপলব্ধির গভীরে প্রবেশ করে কবি তা প্রকাশ করে কবিতায়। কবিতায় চির রহস্যময় মানব জীবন ও জগতের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কাব্য হিসেবে রূপ সাগরের মাঝি কবির আনন্দ বেদনাবিদ্ধ হৃদয়ই কবিতার জন্মভূমি অর্থাৎ সময় বিশেষে কোন একটি বিশেষ সুরকে অবলম্বন করে কবির আনন্দ বেদনা যখন প্রকাশের পথ পায়, তখনই কবিতার জন্ম। কবি বেদনা কে আস্বদ্যমানরস সূতিদান করেন।আসল কথা এইযে,বাহিরের জগতে রূপ রস গন্ধ স্পর্শ বা আপন মনের ভাবনা বেদনা কল্পনা কে যে লেখক অনুভূতি স্নিগ্ধ ছন্দোবদ্ধ তনুশ্রী দান করতে পারেন তাঁকেই আমরা কবি নামে বিশেষিত করি।"রূপ সাগরের মাঝি ' কাব্যগ্রন্থটি যদি মূল্যায়ন করতে যাই তাহলে বলতে পারি কবি আপন মনের মাধুরি মিশিয়ে কাব্যগ্রন্থের প্রতিটা কবিতা রূপদান করতে চেষ্টা করেছেন।কবির কবিতায় ফুটে উঠেছে স্বদেশ প্রীতি,প্রকৃতি প্রেম, নারী প্রেম,হাসি কান্না আনন্দ বেদনা ভরা উপলব্ধি। কবি মো গোলাম রসুল এর কাব্যগ্রন্থের সবগুলো কবিতাই আমি পড়েছি। কিছু কিছু কবিতা পাঠক হৃদয়ে দাগ কাটবে যেমন "ওগো পল্লী মেয়ে", কবিতাটিতে প্রকাশিত হয়েছে গ্রাম্য মেয়ের প্রতি এক নবিন কিশোরর আবেগঘন ভালবাসা। "আষাঢ়ের ঘন নীল গগনে" কবিতাটিতে প্রকাশিত হয়েছে প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা।"তুমি এলে না ফিরে' কবিতাটিতে ফুটে উঠেছে প্রিয়জনকে না পাওয়ার বেদনা। "ভালোবাসার মানচিত্র আঁকা" কবিতাটিতে স্বদেশপ্রীতি। "রূপ সাগরের মাঝি" কাব্যের প্রতিটি কবিতাই প্রেমপ্রীতি, বাংলার আকাশ বাতাস, নদীনালা, পাহাড়পর্বত, সমুদ্র, মানবতারমেল বন্ধন, সম্প্রতির বন্ধন এবং স্বপ্নময় বাস্তব পৃথিবী গড়ে তোলার আহবান। * অন্তর্নিহিত বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে "রূপ সাগরের মাঝি" কাব্যগ্রন্থটির নামকরণ করা হয়েছে। জীবনের ঘনিষ্ঠতম শিল্প কর্মই সাহিত্য। কোন শিল্প কর্মের আঙ্গিকে তাৎপর্য সেই শিল্পের জীবন রক্ষার ধারক। তাই জীবনের সাথে সম্পর্কযুক্ত যে কোন শিল্প কর্মের একটি নান্দনিক নামকরণ সেই সৃষ্টি কর্মকেই পাঠকের মনের মুকুরে শৈল্পিক সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত করে তুলে। "রূপসাগরের মাঝি" কাব্যগ্রন্থটির নামকরণ তাৎপর্য হয়েছে বলে আমি মনে করি। স্বনাম ধন্য কবি সাহিত্যিক জনাব মো গোলাম রসুল প্রেমিক কবি এবং মানবতার কবি। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল "রূপ সাগরের মাঝি" কাব্যগ্রন্থটি। এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম। দীর্ঘদিন তাঁর সাথে আমার কর্মময় জীবন। আমি তাঁকে যতটুকু চিনেছি তিনি একজন স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষ। এক কথায় বলবো স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। তিনি স্বপ্ন দেখেন স্বপ্ন দেখান। তাঁর "রূপ সাগরের মাঝি" কাব্যগ্রন্থটির সফলতা কামনা করছি। আমার বিশ্বাস তিনি আগামী প্রজন্মের জন্য আরও নুতন নুতন সাহিত্য উপহার দিতে পারবেন। কবি ও কলামিস্ট প্রতিবিম্ব প্রকাশ-এর কর্ণধার জনাব আবুল খায়ের ভাইকে ধন্যবাদ ও আন্তরিক অভিনন্দন "রূপ সাগরের মাঝি" প্রকাশনার জন্য। আমি তাঁর প্রতিবিম্ব প্রকাশ এর উত্তরোত্তর সফলতা কামনা করছি। ধন্যবাদান্তে তাহমিনা আক্তার, প্রভাষক বাংলা বিভাগ, নাংগলকোট হাসান মেমোরিয়াল সরকারি ডিগ্রি কলেজ, নাংগলকোট, কুমিল্লা।