পবিত্র বাইবেলে উল্লেখ আছে, ‘মানুষ খালি রুটিতে বাঁচিবে না।’ জৈবিক চাহিদার বাইরেও মানুষের আরেক চাহিদার নাম ‘মানবিক মর্যাদা’। এই মর্যাদা উদ্ধারেই ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাংলাদেশের আপামর মানুষ। জীবন বাঁচাতে তখন কবি শামসুর রাহমান পাড়ি জমিয়েছিলেন এক ‘গণ্ড গ্রামে’। গাঁয়ে বসে যুদ্ধের প্রারম্ভেই কবি জানান দিচ্ছেন: ‘পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত/ ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে,/ নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক/ এই বাঙলায়/ তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা।’ দেড় মাস পর, মে মাসের মাঝামাঝি, কবি যুদ্ধবিধ্বস্ত ঢাকা ফেরেন। যুদ্ধের বাকি সময় ঢাকাতেই তিনি ‘সন্ত্রাসবন্দী’ থাকেন। এ বন্দিদশার মধ্যেই রচিত হয় ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থের যাবতীয় কবিতা। যদিও প্রকাশ পায় ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে। বন্দী শিবির থেকে কোনো মেলোড্রামা নয়। যুদ্ধের ভয়াবহতাকে হজম করে, আত্মস্থ করে, তবেই রচিত হয়েছে এখানকার প্রায় সব কবিতা। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পর, নতুন বন্দিদশায়, ‘বন্দী শিবির থেকে’র প্রতিটি কবিতাকে খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হয়। পাঠে মনে হয়, যুদ্ধের ময়দান থেকে, সারি সারি লাশের মাঝখান থেকে, ভেসে আসছে কোনো করুণ বাঁশির সুর।
নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানা থেকে আরেকটু ভেতরে মেঘনাপাড়ের গ্রাম পাড়াতলী। কবি শামসুর রাহমানের পৈতৃক নিবাস। তবে জন্মেছিলেন ঢাকা শহরের ৪৬ নম্বর মাহুতটুলির বাড়িতে। তারিখ ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর। দশ ভাইবোনের মধ্যে জেষ্ঠ্য তিনি। ১৯৪৮ সালে যখন তার বয়স মাত্র ১৯ বছর তখন মননের গহীন তল্লাটে কবিতার যে আবাদভূমি গড়ে উঠেছিল, তা কেবল উর্বরই হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে নলিনী।কিশোর গুহের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতা। তারপর দে ছুট। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পেয়েছেন আদমজী পুরস্কার (১৯৬৩), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৯), একুশে পদক (১৯৭৭), সাংবাদিকতার জন্যে পেয়েছেন জাপানের মিৎসুবিশি পদক (১৯৯২), ভারতের আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৪) ছাড়াও বহু পুরস্কার। ডিলিট উপাধিতেও ভূষিত হয়েছেন। ‘মর্নিং নিউজ’-এ সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে ১৯৫৭ সালে যে চাকরি জীবন শুরু করেছিলেন, একই পেশায় থেকে ১৯৮৭ সালে দৈনিক বাংলার সম্পাদক পদ থেকে তিনি চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছেন, তবু খেই হারাননি জীবন, সাহিত্য ও কবিতার পাঠ থেকে। মূলত কবি হলেও সাহিত্যে তাঁর কাজ বহুমাত্রিক। অনুবাদ সাহিত্য থেকে গদ্যের বিভিন্ন প্রশাখায় বিচরণ করেছেন তিনি। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট ৭৬ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।