‘স্থলপথ কিংবা সমুদ্রপথে পালাতে চাইলে মিনোস হয় তো আমাদের পথরোধ করবে। কিন্তু আসমান আমাদের জন্য উন্মুক্ত। আমরা এই পথ ধরে এগোব। দুনিয়ার সমস্ত কিছু মিনোসের নিয়ন্ত্রণে, কিন্তু স্বর্গে তাঁর নিয়ন্ত্রণ নেই।’ - ওভিড ক্রিটের রাজা মিনোসের জেলখানায় অবরুদ্ধ ছিলেন গ্রিক পুরাণের মহান ভাস্কর, শিল্পী ও আবিষ্কারক ডেডেলাস ও তাঁর পুত্র ইকারুস। পুত্র ইকারুসকে নিয়ে আকাশপথে জেল থেকে পালাবেন বলে একসময় তিনি আবিষ্কার করেন একজোড়া ডানা। সেই ডানায় ভর করে পালাতেও সক্ষম হন তাঁরা। কিন্তু পুত্র ইকারুসের বাসনা ছিল আরেকটু বেশি: ডানায় ভর করে সূর্যকে স্পর্শ করতে চেয়েছিল সে। কিন্তু বাসনা পূরণের আগেই সমুদ্রে নিপতিত হয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। পুত্রের মৃত্যুতে এক বিহ্বল শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন পিতা ডেডেলাস: ‘পিতা আমি, তাই সন্তানের আসন্ন বিলয় জেনে/ শোকবিদ্ধ, অগ্নিদগ্ধ পাখির মতন দিশাহারা;/ শিল্পী আমি, তাই তরুণের সাহসের ভস্ম আজ/ মৃত্যুঞ্জয় নান্দনিক সঞ্চয় আমার।’ যেন স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে গিয়ে প্রাণহারানো পুত্রের লাশের সামনে দাঁড়িয়ে শোক করছেন এক পিতা। যার কাছে স্বাধীনতাও মূল্যবান, পুত্রও। গ্রিক পুরাণের এত এত চরিত্র থাকতে শামসুর রাহমান কেন ইকারুস ও তার পিতা ডেডেলাসকে তাঁর কবিতার বিষয় করলেন? কেনই-বা কাব্যগ্রন্থের নামকরণ করলেন ইকারুসের আকাশ? এর অভ্যন্তরে কি খেলা করেছে কোনো বাসনাগত সামঞ্জস্য? কবির বাসনা কি মিলে গেছে ইকারুসের বাসনায়, যে বাসনা ভয়ংকর?
নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানা থেকে আরেকটু ভেতরে মেঘনাপাড়ের গ্রাম পাড়াতলী। কবি শামসুর রাহমানের পৈতৃক নিবাস। তবে জন্মেছিলেন ঢাকা শহরের ৪৬ নম্বর মাহুতটুলির বাড়িতে। তারিখ ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর। দশ ভাইবোনের মধ্যে জেষ্ঠ্য তিনি। ১৯৪৮ সালে যখন তার বয়স মাত্র ১৯ বছর তখন মননের গহীন তল্লাটে কবিতার যে আবাদভূমি গড়ে উঠেছিল, তা কেবল উর্বরই হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে নলিনী।কিশোর গুহের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতা। তারপর দে ছুট। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পেয়েছেন আদমজী পুরস্কার (১৯৬৩), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৯), একুশে পদক (১৯৭৭), সাংবাদিকতার জন্যে পেয়েছেন জাপানের মিৎসুবিশি পদক (১৯৯২), ভারতের আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৪) ছাড়াও বহু পুরস্কার। ডিলিট উপাধিতেও ভূষিত হয়েছেন। ‘মর্নিং নিউজ’-এ সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে ১৯৫৭ সালে যে চাকরি জীবন শুরু করেছিলেন, একই পেশায় থেকে ১৯৮৭ সালে দৈনিক বাংলার সম্পাদক পদ থেকে তিনি চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছেন, তবু খেই হারাননি জীবন, সাহিত্য ও কবিতার পাঠ থেকে। মূলত কবি হলেও সাহিত্যে তাঁর কাজ বহুমাত্রিক। অনুবাদ সাহিত্য থেকে গদ্যের বিভিন্ন প্রশাখায় বিচরণ করেছেন তিনি। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট ৭৬ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।