বাংলা সাহিত্যের চিরায়ত মনীষা, আধুনিক বাংলা ভাষা ও বাংলা গদ্যের জনক এবং বাংলা উপন্যাসের চরিত্র চিত্রণের অমর স্রষ্টা ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় [জন্ম: ১৩ আষাঢ়, ১২৪৫ বঙ্গাব্দ; মৃত্যু: ২৬শে চৈত্র, ১৩০০ বঙ্গাব্দ]। যেন তিনি নীল আকাশের অবিনশ্বর ধ্রুব তারা; কখনো উজ্জ্বল জ্যোতির্ময় আবার কখনো মেঘে আচ্ছন্ন আধো অন্ধকার। আর তা তাঁর বিশালতা ও সীমাবদ্ধতা, প্রসারতা ও সংকীর্ণতা, আকাক্সক্ষা ও আত্মসমর্পণ, বীরত্ব ও কাপুরুষতা, স্বাধীনতা ও বন্দিত-এই সবকিছু মিলিয়েই। আর তাই তাঁর অন্বেষণ-বিশ্লেষণ, বিচার-বিবেচনা, মূল্যায়ন-মীমাংসার বিষয়টিও খুব সহজ নয়। তেমনি তিনি সহজ মানুষও ছিলেন না। ইংরেজ শাসকের অধীনস্থ আমলা হয়েও [ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট] তাদের পাত্তা না দিয়ে তাদেরই বিরুদ্ধে মামলা করে জিতেছেন। ইংরেজদের যুক্তির অস্ত্রগুলো ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেছিলেন। ইংরেজি শিক্ষাকে বাংলা শিক্ষার কাজে লাগিয়েছেন। বঙ্কিমের বাংলা ভাষা পরিচর্যার ধারণাও পাশ্চাত্যের ভাষা পরিচর্যার ধারণারই সদর্থক। বঙ্কিম ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্র্যাজুয়েট। ‘প্রথম গ্র্যাজুয়েট’ আরও কেউ কেউ ছিলেন বৈকি! কিন্তু বঙ্কিম ছিলেন ‘বেস্ট অব দি লট’-দলের সেরা। বঙ্কিমের শ্রেণিগত অবস্থানই তাঁকে তাঁর প্রথম জীবনের নিরীশ্বর ও সাম্যবাদী ধ্যান-ধারণা থেকে শেষ জীবনে ধর্মাশ্রয়ী হতে বাধ্য করেছিল। এ জন্য তিনি নিন্দিত হয়েছেন। নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। মূলত প্রত্যক্ষ ও মুখ্যত হেষ্টির হিন্দুশাস্ত্র নিন্দায় জাতীয় অবমাননা বোধে ক্ষুব্ধ হয়ে, পরোক্ষে পিতার স্নেহ ও ভিটাচ্যুত, হাঁপানি ও বহুমূত্র কবলিত, ভগ্নস্বাস্থ্য, অপুত্রক নিঃসঙ্গ আত্মাভিমানী, হতাশ বঙ্কিমচন্দ্রও আকস্মিকভাবে ধর্মাশ্রিত হয়েছিলেন। আকস্মিকতা এ জন্যে যে, পঁয়তাল্লিশ বছর অবধি বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন মুখ্যত কোঁতে, মিল ও বেন্থাম প্রবাহিত প্রত্যক্ষবাদী, নাস্তিক, ঐহিক জীবনে শ্রেয়োকামী, সাম্যবাদী, মানবতার প্রবক্তা প্রচারক। কিন্তু শেষ জীবনে এসে তিনি তাঁর ধর্মাশ্রিত শ্রেণিগত অবস্থানের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন নি; বরং অধোগামী হয়েছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের সমালোচকরা তাঁর সৃষ্টি ও তাঁর জীবনাচারকে বিষমাখা তরবারি নিয়ে টুকরো টুকরো করেছেন। কিন্তু তিনি দমে যান নি। মহা মূল্যবান সৃষ্টির সম্ভারে এবং ভুলে-ভরা গন্তব্যেই তিনি প্রয়াত হয়েছেন। তৎসত্ত্বেও তাঁর অসামান্য সৃষ্টি এবং আধুনিক বাংলা ভাষা ও বাংলা গদ্যের প্রণেতা ও রূপকার হিসেবে তাঁকে আমাদের প্রতিনিয়ত স্মরণ করতে হয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার সঙ্গে তাঁর অবদান ও সৃষ্টি আবশ্যকীয় হয়েই আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল।
কবি ও গবেষক মুস্তাফা মজিদ এর রয়েছে ১০টি কাব্যগ্রন্থ। যথাক্রমে- ‘মেঘবতী সুবর্ণভূমি, “তােকে নিয়ে প্রেম প্রেম খেলা, কুসুমিত পঞ্চদশী’, ‘পুষ্পপত্রে নীলকণ্ঠ’, ‘জনযুদ্ধের কনভয়, ‘সাকিন সুবিদখালী’, ‘স্বাতীর কাছে চিঠি’, Diary of a Nepalese Guerrillas সম্পাদিত কবিতাসমগ্র ঃ মাও সেতুঙ এবং নিবেদিত কবিতা সংকলন ‘প্রাণিত রবীন্দ্রনাথ’ । এই কবি কবিতা লেখার পাশাপাশি বাংলাদেশে বসবাসরত। মঙ্গোলীয় ক্ষুদ্র নৃগােষ্ঠীর মানুষদের নিয়ে গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে লােক প্রশাসন ও আমলাতন্ত্র নিয়েও গবেষণা করে আসছেন। বাংলাদেশের রাখাইন জাতিসত্তার আর্থ-সামাজিক ও প্রশাসনিক সমীক্ষা নিয়ে অভিসন্দর্ভ রচনার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ ডি ডিগ্রী অর্জন করেন। যা বাংলাদেশের রাখাইন’ শিরােনামে বাংলা ভাষায় বাংলা। একাডেমী এবং The Rakhaines শিরােনামে ইংরেজি ভাষায়। ঢাকার মাওলা ব্রাদার্স থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় । ড. মুস্তাফা মজিদের এ পর্যন্ত রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থ সংখ্যা। ৪০ উর্ধ্ব। তার উল্লেখযােগ্য গ্রন্থের মধ্যে ত্রিপুরা জাতি। পরিচয়’, ‘পটুয়াখালীর রাখাইন উপজাতি', আদিবাসী রাখাইন’, ‘মারমা জাতিসত্তা' বাংলাদেশে মঙ্গোলীয়। আদিবাসী’, ‘গারাে জাতিসত্তহজং জাতিসত্তা’, আদিবাসী সংস্কৃতি (১ম ও ২য় খণ্ড), রূপান্তরের দেশকাল’, ‘সমকালের আত্মকথন’, ‘লােক প্রশাসনের তাত্ত্বিক প্রসঙ্গ’, ‘বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র', 'রাজনীতিতে সামরিক আমলাতন্ত্র’, ‘নেতৃত্বের স্বরূপ’, বাংলাদেশে বঙ্কিমচন্দ্র’, ‘মুক্ত ও মুগ্ধদৃষ্টির রবীন্দ্র বিতর্ক’ । আর ছােটদের জন্য রচিত ও সম্পাদিত গল্প গ্রন্থ। ‘দীপুর স্বপ্নের অরণি’, ‘জীবন থেকে’ ও ‘ছােটদের ৭টি মঞ্চ নাটক’ এবং জীবনী গ্রন্থ ‘রূপকথার নায়ক হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন’ ও ‘বঙ্গবীর ওসমানী। মার্কসীয় মুক্ত চিন্তার যৌক্তিক দৃষ্টবাদে অবিচল মুস্তাফা মজিদ কৈশােরে উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান এবং একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে। অংশগ্রহণসহ কৈশাের থেকেই নানা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে। জড়িত । বাংলা একাডেমীর জীবন সদস্য, জাতীয় কবিতা পরিষদ, ছায়ানট, ঢাকা থিয়েটার ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য। এছাড়াও তিনি সত্তর ও আশির দশকে শিশু-কিশাের। সংগঠন গড়া ও নাট্য আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন । পেশায় প্রথমে সাংবাদিকতা এবং পরে ১৯৮৪ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংকে কর্মরত আছেন। বর্তমানে মহাব্যবস্থাপক ড. মুস্তাফা মজিদ ১৯৫৫ সালের ১৪ই এপ্রিল পটুয়াখালী জেলার সুবিদখালীতে জন্মগ্রহণ করেন । ভ্রমণ করেছেন ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, সুইডেন, জার্মানী, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ড।