বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের (১৮৮০-১৯৩২) স্থান একই সঙ্গে অমর আসনে এবং প্রেমের আসনে। তাঁর সাহিত্যকর্মে দৃষ্টি ও প্রকাশ-ভঙ্গির যে মৌলিকতা আমরা লক্ষ্য করি, ভাষার সারল্য, ভঙ্গির তীক্ষ্ণতা এবং রঙ্গব্যঙ্গের যে সূক্ষ্মতা তাতে প্ৰকাশ পেয়েছে, তাতে বাংলা সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট রচয়িতার সম্মান হয়েছে তাঁর প্রাপ্য । তাঁর অপর সাধনক্ষেত্র নারীমুক্তির প্রয়াস। এই মুক্তি তিনি সকলের জন্যে কামনা করেছিলেন। তবে বিশেষভাবে বাঙালি মুসলমান সমাজকেই তিনি উদ্দিষ্টরূপে বেছে নিয়েছিলেন, অপরিসীম পরিশ্রম করেছিলেন তাদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে । তাঁর সাহিত্যসাধনা আর সমাজকর্ম প্রায়শই এক বিন্দুতে এসে মিশেছিল । রোকেয়ার সাধনার সফলতা ও সার্থকতা যাঁদের মধ্যে আমরা প্রত্যক্ষ করি, শামসুন নাহার (১৯০৮-৬৪) তাঁদের একজন। উত্তরকালে তিনি সুপরিচিত হন শামসুন নাহার মাহমুদ নামে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. পাশ করে তিনি অধ্যাপনা করেছেন, সেইসঙ্গে রাজনীতি করেছেন, নারী-আন্দোলন করেছেন, শিশুকল্যাণের নানাবিধ প্রয়াসে যুক্ত থেকেছেন। ভ্রাতা মুহম্মদ হবীবুল্লাহ বাহারের (১৯০৬-৮৩) সঙ্গে মিলে তিনি মর্যাদাবান সাহিত্য পত্রিকা বুলবুল সম্পাদনা করেছিলেন। জীবনী ও স্মৃতিকথামূলক বই ছাড়াও লিখেছিলেন ভ্রমণকাহিনী, গল্প ও প্রবন্ধ। রোকেয়া-জীবনী তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা। এটি কলকাতার বুলবুল পাবলিশিং হাউস থেকে তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাই প্রকাশ করেছিলেন ১৯৩৭ সালে। বইটি কিছুকাল স্কুলপাঠ্য থাকায় এর কয়েকটি পুনর্মুদ্রণও হয়েছিল। ১৯৮৭ সালে লেখিকার পৌত্রেরা বইটির একটি নতুন সংস্করণ প্রকাশ করেন, তাতে এম. ফাতেমা খানমকে লেখা রোকেয়ার একটি পত্র সংযোজিত হয়। সাহিত্য প্রকাশের উদ্যোগে এবারে যে-সংস্করণ প্রকাশিত হচ্ছে, তা মূলত প্ৰথম সংস্করণের অনুসৃতি হলেও প্রথম সংস্করণের বানান-রীতিতে যে দ্বিত্বের ব্যবহার ছিল, বর্তমানে তা বর্জন করা হয়েছে। তবে দ্বিতীয় সংস্করণের সঙ্গে পাঠ মিলিয়ে দেখা হয়েছে। প্রথম প্রকাশকালে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং মোহিতলাল মজুমদার যা লিখেছিলেন, এখনো তার সত্যতা অম্লান। সুনীতিকুমার বলেছিলেন, “এই বইটিতে একটী জীবন্ত প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যায়,- -রোকেয়ার ব্যক্তিত্ব ইহাতে অতি সুন্দরভাবে --- প্রতিফলিত হইয়াছে ।” আর মোহিতলাল লিখেছিলেন, “এই “জীবনী” যিনি লিখিয়াছেন, তিনিও সামান্য নহেন। তিনি যে এমনভাবে এই চরিত্রটি গড়িয়া তুলিয়াছেন, তার কারণ, তিনি এই জীবনকে মনে ও প্রাণে গ্রহণ করিতে পারিয়াছেন...।” রোকেয়া-জীবনীর বর্তমান সংস্করণ সমাদৃত হোক, রোকেয়ার প্রেরণা বাংলাদেশের নারী মুক্তি ত্বরান্বিত করুক, শামসুন নাহার মাহমুদের রচনা ও কর্ম দেশের মেয়েদের চিত্তে বেগ সঞ্চার করুক, এর চাইতে অধিক আজ আর আমরা কী চাইতে পারি ?