শশাঙ্ক মুখার্জি গ্রামাঞ্চলের এক পাড়াগায়ের বিখ্যাত ডাক্তার । পাশাপাশি দুইটা গ্রামে তার চেম্বার। ইচ্ছা করলে শহরে গিয়ে বড় চাকরি করতে পারতেন কিন্তু পৈতৃক ভিটা ছেড়ে যাননি,লোকের সেবা করার ব্রত নিয়েছেন। সংসারের অবস্থা খুবই ভালো,একটা মোটর গাড়ি কেনার কথাও ভাবছেন। এনার আরেকটা পরিচয় আছে ইনি তার গায়ের মাথা, ডানহাত সবই। এক অর্থে উনিই সিদ্ধান্ত নেবেন, উনিই বাস্তবায়ন করবেন। সবাই একবাক্যে মেনেও নেয় তাকে। শশাঙ্ক ডাক্তার খুব নীতিবান মানুষ, অন্যায় দু চক্ষে সহ্য করতে পারেন না। তাইতো, যখন গ্রামের এক বিধবা মেয়ে বিপত্নীক একজন লোকের সাথে অবৈধ সম্পর্ক তৈরি করলো তিনি কোনোকিছু না ভেবে রাগ ও ঘৃনার সাথে তাদের বিধান দিয়ে দিলেন, বিন্দুমাত্র মায়াদয়া দেখালেন না গর্ভবতী মেয়েটার প্রতি। শশাঙ্ক ডাক্তারের চরিত্র এমন খাঁটি যে শহরে থেকে কলেজে পড়ার সময়েও কোন তরুনীর দিকে চোখ তুলে তাকাননি স্ত্রী ছাড়া আর কোন নারীকে তিনি জানেননি। এই শশাঙ্ক ডাক্তারের জীবনে প্রেম এলো। গায়ের পালাতে খেমটা নাচ দিতে প্রতিবছরই মেয়েরা আসে, শশাঙ্ক ডাক্তার এসব দেখতেও যান না। এবার অসৎ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে দেখতে গিয়ে পান্না নামের একটা মেয়ের সাথে পরিচয় হলো তার। মেয়েটাকে দেখামাত্র তার কি যেন হয়ে গেলো, কিছুতেই তার নীতিতে তিনি অটল থাকতে পারছেন না, মনকে বোঝাতে পারছেন না যে এসব ঠিক না। মেয়েটা যেন তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে এতদিন তিনি যে জীবন যাপন করছিলেন তা অতি সাধারণ, অতি মুখের দিকে তাকালেই তিনি অন্য এক জগতকে দেখতে পান। ক্ষুদ্র। মেয়েটার আকর্ষনটা ঠিক পরনারী আকর্ষণ বা শারীরিক আকর্ষণ বলা যায় না, পুরো ব্যাপারটাই মনস্তাত্ত্বিক। তার জীবনে এই মেয়ের চেয়ে সুন্দরী মেয়ে অনেক দেখেছেন, কিন্তু তাদের বোন ছাড়া কিছু ভাবেননি। কিছু কিছু মানুষকে দেখলেই আপন লাগে,মনে হয় এই মানুষটা আমার টাইপ... এরকম কিছু একটা শশাঙ্ক ডাক্তারের মনে হয়েছিলো। সেই মুহূর্তে তিনি বিধবা মেয়েটা আর বিপত্নীক লোকটার প্রেমের সম্পর্কের পেছনের ভালোবাসাটাও যেন দেখতে পেলেন
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।