গ্রাম্যজীবনে অভ্যস্ত গদাধর একজন পাটের আড়তদার। সহধর্মিণী অনঙ্গকে বিয়ে করে যখন ঘরে আনেন তখন অনঙ্গের বয়স মাত্র তেরো। সেই থেকে কুড়ি পেরিয়ে যাওয়া অনঙ্গকে দেখে ছাব্বিশ-সাতাশের গদাধর বর্তমানেও বিমোহিত থাকে। কিংবা বলা চলে থাকতো। গ্রামীণ জীবনের পাট চুকিয়ে একটা সময় সংসার নিয়ে কলকাতায় পারি জমালো গদাধর। তাদের সাথে আড়তের মুহুরী এবং গদাধরের বাবার আমলের অত্যন্ত বিশ্বস্ত কর্মচারী ভড়মশাই। কলকাতার দিনকাল মন্দ চলছিল না। অনঙ্গ-গদাধরের সুখের সংসারের দুষ্ট-মিষ্টি খুনসুটি কলকাতার যান্ত্রিকতাতেও স্বস্তির শ্বাস নিতে দিচ্ছিলো। কিন্তু তা খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। গ্রামের বন্ধু শচীন এবং আরেক পরিচিত নির্মলের সহচর্যে গদাধরের পরিচয় হয় অন্য আরেকটি দুনিয়ার সাথে। গদাধরের সামনে আসেন সেসময়ের নামী অভিনেত্রী শোভারাণী মিত্র। এতকাল অবধি গ্রামীণ নারীর সরলতা, আতিথেয়তা আর বিনম্রতার কুণ্ঠিত স্পর্শে থেকে শহুরে শিক্ষিতা-আত্মমর্যাদায় প্রত্যয়ী নারীর স্বরূপ যেন গদাধরকে বিস্ময়ের ঘূর্ণিপাকে ফেলে দিলো। জীবন সম্পর্কে তার ধ্যানধারণার আমূল -পরিবর্তনের সূচনা হলো। তার মনে হতে লাগলো জীবন তাকে খুব ঠকিয়েছে! জীবন তাকে এমন নারীর সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত করে যেন পার্থিব সকল সুখ থেকেই বঞ্চিত করে রেখেছিল এতকাল! তারপর? তারপর লেখক আমাদের নিয়ে বেশ খানিকটা সময় সাপ-লুডু খেলেছেন! জীবনের এই সাপলুডুতে বিষধর সাপের মতো মানুষের স্বার্থ যেমন এসেছে, তেমনি চিরচেনা বিভূতিস্ট্যাম্পের সদাসহায়ক চরিত্র ভড়মশাই থেকেছেন লম্বাচওড়া সিড়ি হয়ে! অনঙ্গের জীবনে এসেছে চড়াই-উতরাই-গদাধর পেয়েছে উচ্চাভিলাষের পরিণতি!
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।