কিশোরী পান্নার প্রেম-চেতনার কাহিনিই ‘অথৈ জল’-এর অন্যতম উপজীব্য বলে আমাদের মনে হয়। ‘বাড়িউলী মাসী’কে ছেড়ে প্রায় চল্লিশ বছর বয়স্ক নায়ক (ডাক্তার)-এর হাত ধরে স্বতন্ত্র বাসায় এসে উঠতে সে দ্বিধা করেনি। নিজে নৃত্যগীত করে জীবিকা অর্জন করেছে, ডাক্তার তখন কিছু উপার্জন না করলেও তাকে কোনোভাবে উত্ত্যক্ত করেনি। তার অন্তরের প্রাণচাঞ্চল্য ও প্রেমবহ্নি আদৌ নির্বাপিত হয়নি। এদিক থেকে দেখতে গেলে পান্না একটি আশ্চর্য চরিত্র। কাহিনির শেষ পর্যায়ে পুলিশ যখন ওদের ঘিরে ফেললো, এবং নায়ককে (ডাক্তার) ধরে নিয়ে যেতে উদ্যত, তখন তাকে বাঁচাবার জন্য নিজেকে সে ওর জীবন ও প্রেম থেকে ছিন্ন করে নিয়ে চলে গেল। এই ত্যাগে তার অন্তরাত্মা যে কতখানি কেঁদেছিল, তা অকথিতই থেকে গেল। পক্ষান্তরে নায়ক বা শশাঙ্ক ডাক্তারের চরিত্র যদি ধরি, তাহলে দেখতে পাবো, মানুষটি কতো নীতিজ্ঞ ছিল। শান্তি ও তার প্রেমাস্পদের ব্যাপারে এই নীতিরক্ষার জন্যই সে ছিল প্রচণ্ডভাবে নির্মম। সমাজের মাথা হিসেবে সে তাদের দণ্ড দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। কিন্তু এই নীতিবাগীশ মানুষটি নিজে যখন পান্নার প্রেমে পড়লো, তখন বুঝলো প্রেমের কী স্বরূপ! নিজের প্রেমানুভূতি দিয়ে সে বুঝলো শান্তি আর তার প্রেমাস্পদের মধ্যে যে প্রেমসঞ্চার হয়েছিল, তা কতখানি গভীর। না হলে সমাজের সব বন্ধন তুচ্ছ করে তারা দুজনে গ্রাম ছেড়ে ভিন্ন দেশে পালিয়ে যায়! ডাক্তার শশাঙ্কও পান্নার জন্য নিজের পসার, নিজের স্ত্রী, নিজের ঘরসংসার সব ভাসিয়ে দিয়ে উন্মত্তের মতো তার প্রেমাস্পদার প্রতি ধাবমান হয়েছিল। নিজের প্রেম দিয়ে সে শান্তি ও তার প্রেমিক রামপ্রসাদের প্রেমকে উপলব্ধি করতে পেরেছিল। এই উপলব্ধিই ‘অথৈ জল’ উপন্যাসের মূল কথা বলে আমরা মনে করি।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।