সকালবেলা চা নিয়ে খালেদের রুমে মাত্র ঢুকেছে ছবি, ঢুকে দেখে শিশুর ভঙ্গিতে ঘুমাচ্ছে খালেদ। ছবি তাকে ডাকবে কি ডাকবে না ভাবছে, হঠাৎ ছটফট করতে করতে বিছানায় উঠে বসল খালেদ। দিশেহারা চোখে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল । ছবি অবাক হল। কী হয়েছে? স্বপ্ন দেখেছি । কী স্বপ্ন মাকে নিয়ে । খারাপ স্বপ্ন? হ্যাঁ। মাকে নিয়ে খুব খারাপ একটা স্বপ্ন দেখেছি। খালেদের মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। দেখি, আমার মা আমার জন্য খুব কাঁদছে। খুব কাঁদছে। মাকে ছেড়ে এতদিন কখনও কোথাও থাকিনি আমি । ছবি শান্ত গলায় বলল, চা নাও। খালেদ চায়ের কাপটা নিল। সত্যি বলছি, মাকে ছেড়ে এতদিন..... কিন্তু আছ কেন? মা তোমার জন্য এত কষ্ট পাচ্ছেন, তোমার উচিত তাঁর কাছে ফিরে যাওয়া। ছবির কথা শুনে খালেদ যেন পাথর হয়ে গেল। চায়ে চুমুক দিল না সে। কাপটা বিছানার পাশে নামিয়ে রাখল। ছবি বলল, আমার মা নেই। সাত বছর আগে মারা গেছেন। আমি জানি, মা কী ? খালেদ বলল, আমিও জানি। তুমি জানো, মার কথা ভেবেই তোমার ব্যাপারে আমি অমন ভয় পেয়েছিলাম যদি সত্যি সত্যি মা তোমাকে পছন্দ না করেন! হাত বাড়িয়ে ছবির একটা হাত ধরল খালেদ। ছবি, মাকে এভাবে কষ্ট দেয়া ঠিক হচ্ছে না আমাদের। নানাভাইকে কষ্ট দেয়া ঠিক হচ্ছে না। ছবি কথা বলল না। খালেদ বলল, এখনও কি তোমার রাগটা কমেনি ছবি রহস্যময় গলায় বলল, আমি কেন রাগ করেছি তুমি বলো তো? তা আমি জানি না । তুমি আমাকে বলো, আমি কী করেছি। কোথায় আমার ভুল হয়েছে? ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে দুহাত একত্র করল খালেদ। কেঁদে ফেলল। আমার কোনও ভুল হয়ে থাকলে তুমি আমাকে ক্ষমা করো ছবি। তুমি ফিরে চল। প্লিজ, তুমি ফিরে চল। খালেদের আচরণে বুকের ভেতরটা এমন মোচড় দিয়ে উঠল ছবির। গভীর আবেগে দুহাতে খালেদের হাত দুটো ধরল সে। কিছু একটা বলতে যাবে, ঠিক তখুনি মুস্তাফা সাহেবের ডাক। ছবি, ছবি । খালেদের হাত ছেড়ে দিল ছবি। বাবা ডাকছেন। আমি যাই। ছবি দৌঁড়ে বেরিয়ে গেল । কিন্তু তখন আশ্চর্য এক রাগে ফেটে পড়ছে খালেদ। বিড়বিড় করে বলল, চাচাকে এখনও বাবা বাবা করছে। ফাজলামোর একটা সীমা থাকা উচিত।
১৯৫৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বিক্রমপুরের মেদিনীমণ্ডল গ্রামে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের জন্ম। লেখনীশক্তির পাশাপাশি তার রয়েছে নাট্যরচনায় পারদর্শিতা। বর্তমানে বাংলাদেশের মূলধারার সংবাদপত্র ‘কালের কন্ঠ’-এর সম্পাদক পদেও নিয়োজিত রয়েছেন তিনি। শিশুতোষ গল্প দিয়ে সাহিত্য অঙ্গনে এ গুণী লেখকের প্রবেশ, যা প্রকাশিত হয়েছিলো ‘কিশোর বাংলা’ নামক এক পত্রিকায়। তবে পাঠকের নজরে পড়েছিলেন ‘সজনী’ নামের ছোট গল্প লিখে। খুব অল্প বয়সে তিনি লেখালেখিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ফলে তার লেখার বিষয়বস্তুতে কোনো জটিল সমীকরণের দেখা মিলতো না, পাঠককে বিমল আনন্দ দেয়ার উদ্দেশ্যে প্রথমদিকে তিনি ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ বিষয়গুলোকে পরিহার করেছিলেন। তবে পরবর্তীতে ইমদাদুল হক মিলন এর বই সমূহ-তে মুক্তিযুদ্ধ, হাজাম সম্প্রদায়ের জীবন, প্রবাসী শ্রমিকদের দুঃখগাথা, পাটচাষী, গ্রাম বাংলার সমাজের এক নিখুঁত চিত্রও ফুটে উঠতে দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে লেখকের বক্তব্য, তিনি নিজেই লেখার এরকম বিপরীতধর্মী দুটি ধরন আপন করে নিয়েছেন, আর এক্ষেত্রে তার অণুপ্রেরণা ছিলেন সমরেশ বসু। ইমদাদুল হক মিলন এর বই সমগ্র-তে স্থান পেয়েছে প্রায় দেড় শতাধিক নাটক এবং প্রায় দু’শো উপন্যাস। শিশুতোষ গল্প এবং ভৌতিক উপন্যাস রচনাতেও তার জুড়ি নেই। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ সৃষ্টিশীলতার কারণে বাংলা উপন্যাস ইমদাদুল হক মিলন এর কাছে কৃতজ্ঞ। শুধু বাংলাদেশ না, পশ্চিমবঙ্গেও তার সমান জনপ্রিয়তা রয়েছে। দুই বাংলায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী তার বহুল পঠিত উপন্যাস হলো ‘নূরজাহান’। এছাড়াও ইমদাদুল হক মিলন এর উপন্যাস সমগ্র বিভিন্ন পাঠকপ্রিয় উপন্যাসে ঠাসা। তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো ‘জিন্দাবাহার’, ‘নিঝুম নিশিরাতে’, ‘যাবজ্জীবন’, ‘কালাকাল’, ‘কালো ঘোড়া’, ‘ভূমিপুত্র’, ‘পরাধীনতা’, ‘কে’, ‘তাহারা’, ‘ভূতের নাম রমাকান্ত কামার’ ইত্যাদি। দেশি-বিদেশি নানা সম্মানজনক পুরস্কারের পাশাপাশি ২০১৯ সালে তিনি একুশে পদক পান।