আনিস, পেশায় যে একজন আমলা, যার জীবনবৃত্তান্ত মানুষ হিশেবে আমার অপরাধসমূহ-এর বিষয়, একজন স্পর্শকাতর, এবং অত্যন্ত স্বাভাবিক ও অত্যন্ত অস্বাভাবিক মানুষ, যার কাছে জীবনের প্রতিটি ঘটনাই অপরাধের মতো। আনিসের কাছে তার জীবনযাপন হচ্ছে নিরন্তর অপরাধযাপন। হুমায়ুন আজাদ আনিসের জীবন বর্ণনা করেছেন তরুণ বয়স থেকে পঞ্চাশোত্তর বয়স পর্যন্ত; আনিস নিজে তার অপরাধগুলো বর্ণনা করেছে অকপটভাবে, গভীর অপরাধবোধের সাথে। আকস্মিক এক দুর্ঘটনার মধ্যে দিয়ে সে জড়িয়ে পড়ে বন্ধুস্ত্রী ডলির সাথে, বিয়ে করে তাকে সুখী করার সাধনা করে, যদিও তার সাধনা করো চোখে পড়ে না; আবার ডলিকে সে কখনো নিজের স্ত্রী বলেও ভাবতে পারেনা। আনিস বিয়ের মধ্যে দিয়ে নতুন মানব সৃষ্টি করতে চায় না, সন্তান জন্ম দেয়া অপরাধ বলে মনে হয় তার, সে তার মতো আরো অপরাধী সৃষ্টি করতে চায় না; সে থাকতে চায় নিঃসন্তান, নিঃসঙ্গ, নির্জন। কিছুই তাকে সুখী করে না; কিছুই তাকে দুঃখ দিতে পারে না। আনিস কখনো ব্যর্থ নয়, ব্যর্থ হতে সে জানে না; সাফল্য সে চায় না, কিন্তু সাফল্য ছাড়া সে বাঁচতে পারে না; ব্যর্থ হওয়া তার কাছে অপরাধ, সফল হওয়াও অপরাধ। নারীসংস্পর্শে সে অনেক এসেছে, বারবার অপরাধ করেছে, নারীদের কাছে অপরাধ করেছে, অপরাধ করেছে নিজের কাছেও। মধ্যেপঞ্চাশে একটি বালিকার সংস্পর্শে তার কোনো অপরাধবোধ হয় নি, তবে বালিকাটি চলে যাওয়ার পরই তার অপরাধবোধ জেগে ওঠে, এবং আনিস, আরো সাফল্য যার জন্যে অবাধারিত ছিল, পদত্যাগ করে তার উচ্চ পদ থেকে। সে বেরিয়ে যায় শহর আর সভ্যতা থেকে; যে-প্রকৃতি সে চেনে না আশ্রয় নিতে চায় তার মধ্যে। ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল ও সবকিছু ভেঙে পড়ের পর হুমায়ুন আজাদের এ উপন্যাসও পাঠকদের আলোড়িত ও পীড়িত করবে স্বপ্নে ও জাগরণে।
প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরে গিয়ে ব্যক্তিগত অভীষ্ট এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার মাধ্যমে ধর্ম, মৌলবাদ, প্রতিষ্ঠান ও সংস্কারের বিরুদ্ধে কলম তুলে নিয়ে বিশেষভাবে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ। প্রথাবিরোধী এবং বহুমাত্রিক এই লেখক একাধারে ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, সমালোচক, গবেষক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার, ভাষাবিজ্ঞানী এবং অধ্যাপক। বাবা-মায়ের বড় সন্তান হুমায়ুন আজাদ ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কাটে রাঢ়িখাল গ্রামে, যার কথা পরবর্তীতে তাঁর বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে উঠে এসেছে। ম্যাট্রিকুলেশন ও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। এখান থেকেই তিনি বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। হুমায়ুন আজাদ এর বই সমূহ নারীবাদকে তুলে ধরেছে ও ধর্মীয় মৌলবাদের প্রবল বিরোধিতা করেছে, যার ফলে তিনি একশ্রেণীর মানুষের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন। হুমায়ুন আজাদ এর বই এর মধ্যে 'পাক সার জমিন সাদ বাদ', 'সব কিছু ভেঙে পড়ে', 'ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল' ইত্যাদি উপন্যাস ও 'অলৌকিক স্টিমার', 'জ্বলো চিতাবাঘ', 'কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু' ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ উল্লেখযোগ্য। হুমায়ুন আজাদ এর বই সমগ্র এর মধ্যে 'নারী' প্রবন্ধটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যা একসময় নিষিদ্ধ হয়েছিল এই দেশে। প্রতিভাবান এই সাহিত্যিক ২০০৪ সালের ১১ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে 'বাংলা একাডেমি পুরস্কার', 'একুশে পদক' সহ আরো অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন হুমায়ুন আজাদ।