এক বড়ো অশুভ সময় এসেছে পৃথিবীতে, যারা অন্ধ তারা চোখে সবচেয়ে বেশি দেখতে তো পাচ্ছেই, তারা অত্যন্ত বেশি বিশ্বাস করছে, এবং পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বাসের বিকট মহামারি। এখন সবাই বিশ্বাস করছে, সবাই বিশ্বাসী; কারো পক্ষে এখন বলা সম্ভব হচ্ছে না– আমি বিশ্বাস করি না, আমি অবিশ্বাস করি। বিজ্ঞানের এই অসাধারণ যুগে যখন কিছু অবিশ্বাস সৌরলোক পেরিয়ে ঢুকতে চাচ্ছে মহাবিশ্বে, তখন পৃথিবী মেতে উঠেছে মধ্যযুগীয় বিশ্বাসে; শক্তিলোভী ভ্রষ্ট রাজনীতিকেরা মানুষকে আক্রান্ত ক’রে তুলছে বিশ্বাসের রোগে। এখন পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন বিধাতা পালন করছে অত্যন্ত সক্রিয় রাজনীতিক ভূমিকা, আর গণতন্ত্রমত্ত শক্তির উৎসরা নির্বাচিত ক’রে চলছে বিভিন্ন বিধাতাকে। তবে বিশ্বাস শুধু অতিমানবিক সত্তায়ই সীমাবদ্ধ নয়; হাজার হাজার শূন্য প্রথা বিশ্বাস ক’রে চলছে তারা, যা খুবই ক্ষতিকর। বাংলাদেশে আজ সবাই বিশ্বাসী; শক্তিমানতম থেকে দুর্বলতম বাঙালিটি প্রচণ্ডভাবে পালন ক’রে চলছে বিশ্বাস। এখানে একমাত্র হুমায়ুন আজাদই বলতে পারেন-আমি অবিশ্বাস করি। তাঁর অবিশ্বাস শুধু অতিমানবিক সত্তায় অবিশ্বাস নয়, তাঁর অবিশ্বাস এর থেকে অনেক গভীর; তিনি অবিশ্বাস করেন এ-সভ্যতার প্রায় সমস্ত প্রচারে। সবকিছুই তিনি বিচার ক’রে দেখতে চান; এবং এর ফলেই জন্মেছে এই অসামান্য দার্শনিক গ্রন্থটি। এ-বইয়ের পরিচ্ছদ পরস্পরায় তিনি খুলে খুলে দেখিয়েছেন বিশ্বাসের অন্তঃসারশূন্যতা। প্রথম প্রকাশের পর থেকে আমার অবিশ্বাস নন্দিত হয়ে এসেছে বাঙলা ভাষায় লেখা অনন্য বই হিসেবে। এবার প্রকাশিত হলো বইটির পরিশুদ্ধ সংস্করণ।
প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরে গিয়ে ব্যক্তিগত অভীষ্ট এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার মাধ্যমে ধর্ম, মৌলবাদ, প্রতিষ্ঠান ও সংস্কারের বিরুদ্ধে কলম তুলে নিয়ে বিশেষভাবে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ। প্রথাবিরোধী এবং বহুমাত্রিক এই লেখক একাধারে ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, সমালোচক, গবেষক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার, ভাষাবিজ্ঞানী এবং অধ্যাপক। বাবা-মায়ের বড় সন্তান হুমায়ুন আজাদ ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কাটে রাঢ়িখাল গ্রামে, যার কথা পরবর্তীতে তাঁর বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে উঠে এসেছে। ম্যাট্রিকুলেশন ও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। এখান থেকেই তিনি বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। হুমায়ুন আজাদ এর বই সমূহ নারীবাদকে তুলে ধরেছে ও ধর্মীয় মৌলবাদের প্রবল বিরোধিতা করেছে, যার ফলে তিনি একশ্রেণীর মানুষের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন। হুমায়ুন আজাদ এর বই এর মধ্যে 'পাক সার জমিন সাদ বাদ', 'সব কিছু ভেঙে পড়ে', 'ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল' ইত্যাদি উপন্যাস ও 'অলৌকিক স্টিমার', 'জ্বলো চিতাবাঘ', 'কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু' ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ উল্লেখযোগ্য। হুমায়ুন আজাদ এর বই সমগ্র এর মধ্যে 'নারী' প্রবন্ধটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যা একসময় নিষিদ্ধ হয়েছিল এই দেশে। প্রতিভাবান এই সাহিত্যিক ২০০৪ সালের ১১ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে 'বাংলা একাডেমি পুরস্কার', 'একুশে পদক' সহ আরো অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন হুমায়ুন আজাদ।