জলকদর। একটি অদ্ভুত নাম, হয়তো আরবের মরুভূমির কোনো মাসের নাম; কিন্তু ওই নামেই রাখা হয়েছে বাঙলার গ্রামের একটি শিশুর নাম। সে বেড়ে উঠেছে-পুকুরের পাশে, পুকুরের মধ্যে, বন্যায়, চাঁদের নিচে, সূর্যের নিচে, জ্যোৎস্নায়, ধানখেতে, পাটখেতে, নৌকা বাইচে, হাডুডু খেলায়, যাকে নিয়ে একটি অভাবিত উপন্যাস লিখেছেন হুমায়ুন আজাদ। নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু শুরু যখন জলকদর বছর দশের বালক, শেষ যখন সে বছর পনেরোর কিশোর। জ্যৈষ্ঠে এক হঠাৎ বর্ষার সূচনায় জলকদর চিনতে পারে নিজেকে, নিজের অসীম আনন্দকে, আর ওই দিনই সে মুখোমুখি হয় তার জীবনের চরম সংকটের, মৃত্যুর। মৃত্যুকে পেরিয়ে সে এগিয়ে যেতে থাকে জীবনের দিকে, ধানখেতের দিকে, তিলখেতের দিকে, সরষের হলদের দিকে, বোরোধানের সোনার দিকে, আর সোনার থেকেও রঙিন উজ্জ্বল জীবনের ক্ষুধার দিকে। পল্লী আর প্রভৃতি হারিয়ে যাচ্ছে আধুনিক বাঙলা ভাষা থেকে, সবকিছু এখন রুগ্ন শহরের দিকে ধাবিত; কিন্তু জলকদর থেকে নয়, কোনো ভাবাবেগ নয়, সে এক বালক, যে তারই মতো প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। হুমায়ুন আজাদ নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু-তে বাল্যজীবনের মধুর চাকের মধু গদ্যের ভেতর দিয়ে কবিতায় আর কবিতার ভেতর দিয়ে গদ্যে এমন ভাবে পান করেছেন, যার তুলনা নেই বাঙলা ভাষায়।
প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরে গিয়ে ব্যক্তিগত অভীষ্ট এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার মাধ্যমে ধর্ম, মৌলবাদ, প্রতিষ্ঠান ও সংস্কারের বিরুদ্ধে কলম তুলে নিয়ে বিশেষভাবে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ। প্রথাবিরোধী এবং বহুমাত্রিক এই লেখক একাধারে ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, সমালোচক, গবেষক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার, ভাষাবিজ্ঞানী এবং অধ্যাপক। বাবা-মায়ের বড় সন্তান হুমায়ুন আজাদ ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কাটে রাঢ়িখাল গ্রামে, যার কথা পরবর্তীতে তাঁর বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে উঠে এসেছে। ম্যাট্রিকুলেশন ও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। এখান থেকেই তিনি বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। হুমায়ুন আজাদ এর বই সমূহ নারীবাদকে তুলে ধরেছে ও ধর্মীয় মৌলবাদের প্রবল বিরোধিতা করেছে, যার ফলে তিনি একশ্রেণীর মানুষের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন। হুমায়ুন আজাদ এর বই এর মধ্যে 'পাক সার জমিন সাদ বাদ', 'সব কিছু ভেঙে পড়ে', 'ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল' ইত্যাদি উপন্যাস ও 'অলৌকিক স্টিমার', 'জ্বলো চিতাবাঘ', 'কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু' ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ উল্লেখযোগ্য। হুমায়ুন আজাদ এর বই সমগ্র এর মধ্যে 'নারী' প্রবন্ধটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যা একসময় নিষিদ্ধ হয়েছিল এই দেশে। প্রতিভাবান এই সাহিত্যিক ২০০৪ সালের ১১ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে 'বাংলা একাডেমি পুরস্কার', 'একুশে পদক' সহ আরো অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন হুমায়ুন আজাদ।