‘ব্রাজিলের নির্বাচিত ছোটগল্প’ সংকলনে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে বর্তমান সময়ের দশজন লেখকের বাছাই করা পনেরোটি ছোটগল্প/অণুগল্প সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এই দশজন লেখকের মধ্যে তিনজন নারী লেখক রয়েছেন। এই সংকলনে মোট সাতজন লেখকের একটি করে ছোটগল্প আছে। এঁরা হলেন মাচাদো ডি আসিস, জায়ও গিমারিস রোসা, ডাল্টন ট্রেভিস্যান, মোয়াসার স্কিলিয়ার, নেলিদা পিনওন, মিল্টন হাতুম এবং আন্তোনিয় প্রাতা। অন্যদিকে ক্লারিস লিসপেক্তরের দু’টি ছোটগল্প এবং পাওলো কোয়েলহো ও অ্যাড্রিয়ানা লিসবোয়ার তিনটি করে অণুগল্প স্থান পেয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রাজিলের বিখ্যাত ছোটগল্পকার মাচাদো ডি আসিস। তাঁর ‘মধ্যরাতের মহোৎসব’ গল্পটি তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। অনেকের মতে, এই গল্পটির সঙ্গে জেমস জয়েসের ‘এরাবি’ গল্পের মিল রয়েছে, বিশেষ করে অধিবক্তা যুবকটির আবেগ এবং স্বপ্ন। এই গল্পের কাহিনী অলম্বনে ‘মিসা ডু গ্যালো’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। অন্যদিকে বিংশ শতাব্দীর ব্রাজিলের বিখ্যাত ছোটগল্প-লেখক জায়ও গিমারিস রোসা। সমালোচকদের দৃষ্টিতে ‘নদীর তৃতীয় কূল’ তাঁর অন্যতম সেরা গল্প। এই গল্পটিতে লেখক একজন নিরীহ পিতার মানসিক পরিস্থিতির বিয়োগান্তক পরিণতির করুণ কাহিনী তুলে ধরেছেন। এই গল্পে নদীকে বহমান জীবনকে বোঝানোর জন্য মেটাফর হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া নদী পারাপারের জন্য বাহন হিসেবে অথবা কফিনের রূপকার্থে নৌকো উল্লেখ করার জন্য হয়েছে। তবে গল্পের অন্তরালে একটা জটিল এবং প্রসন্ন প্রশ্ন কিন্তু অমীমাংসিত থেকে যায় এবং তা হল— নদী কি সময়, নাকি মরণ, নাকি উভয়ই? পাঠকমহলে গল্পটি এত বেশি সমাদৃত হয়েছে যে, বিভিন্ন সময়ে একাধিক ইংরেজি সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ক্লারিস লিসপেক্তরের ‘গোপন সুখ’ গল্পে একজন বালিকার নারী হয়ে ওঠার ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। লেখিকা অধিবক্তার মুখে স্বীকারোক্তি করেছেন, ‘আমি আর বইপড়ুয়া বালিকা নই; আমি একজন নারী এবং তার প্রেমিকা’। তাঁর দ্বিতীয় গল্প ‘প্রথম চুম্বন’ও কিশোর বয়সের রোমান্টিক গল্প। তবে ঘটনা আলাদা। এই গল্পে লেখিকা কৈশোর পেরিয়ে পরিপূর্ণ পুরুষে রূপান্তরিত হওয়ার সনাতন নিয়মকে স্বাভাবিক ঘটনার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। ডাল্টন ট্রেভিস্যানের ‘পেনিলোপ’ একটি ভুতুড়ে গল্প। লেখক একটি চিঠির ভেতরের কথা গোপন রেখে পাঠকের মনে উৎকণ্ঠা এবং কৌতূহল সৃষ্টি করে অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে গল্পটি সমাপ্ত করেছেন। মিল্টন হাতুমের ‘নিশীথে অনাহূত পাঠক’ও ভৌতিক গল্প। তবে এই গল্পে লেখক নিজের বিবেকের সঙ্গে বোঝাপড়ার নাটকীয় ঘটনা তুলে ধরেছেন। অন্যদিকে মোয়াসার স্কিলিয়ারের ‘ক্যারোলা’ একটি রূপকধর্মী গল্প। লেখক জাদুবাস্তবতার সঙ্গে ক্যানিবলিজম্ এবং কল্পনার রঙ মিশিয়ে এক অলৌকিক এবং অকল্পনীয় কাহিনী বর্ণনা করেছেন এই গল্পে। নেলিদা পিনওনের ‘ভালোবাসি স্বামীকে’ একটি নারীবাদী গল্প। এই গল্পে লেখিকা পুরুষ-শাসিত সমাজের সনাতন অবকাঠামো এবং দাম্পত্যজীবনের ভালোবাসা ও চড়াই-উৎরাইয়ের পরও নারীজীবনের অভীষ্ট লক্ষ্য ও দৈনন্দিন জীবনের কর্মকা- অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। অনেকটা সেই আপ্তবাক্যের মতোই, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’।
এই সংকলনে ব্রাজিলের খ্যাতনামা লেখক পাওলো কোয়েলহো’র তিনটি অণুগল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গল্পগুলো হল— ‘কাঠপেন্সিলের গল্পকথা’, ‘টোকিওর এক শুঁড়িখানায়’ এবং ‘প্যান্ডোরার বাক্স’। এই তিনটি অণুগল্পে তিনি তাঁর চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন এবং আশা-আকাক্সক্ষার কাহিনী অল্প কথায় ফুটিয়ে তুলেছেন।
অ্যাড্রিয়ানা লিসবোয়া’র ‘উঠান’ এবং ‘পুনর্মিলন’ অণুগল্প দু’টির মূল বিষয় নস্টালজিয়ার ধূসর চাদরে ঢাকা ফেলে আসা অতীতজীবনের স্মৃতি রোমন্থন, তবে প্রেক্ষাপট এবং অনুভূতি আলাদা। ‘উঠান’ গল্পে লেখিকা শৈশবের স্কুলছুটির সময় দাদুবাড়ি বেড়াতে যাওয়ার মধুর স্মৃতি শিশুর দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণনা করেছেন এবং ‘পুনর্মিলন’ গল্পে তিরিশ বছর পরে ব্রাসিলিয়া শহরে ফেরত যাওয়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। এছাড়া ‘খাড়াই’ অণুগল্পে লেখিকা অ্যাড্রিয়ানা লিসবোয়া আপন শহর পেছনে ফেলে আসার যে হৃদয়বিদারক কষ্টের অনুভূতি, তা অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে তিরিশোত্তর মানুষের জীবনে চাওয়া-পাওয়ার জটিল হিসাব এবং না-পাওয়ার অতৃপ্তির বেদনাকে সহজভাবে গ্রহণ করার মানসিক প্রস্তুতির কথা বলা হয়েছে তরুণ লেখক আন্তোনিয় প্রাতা’র ‘বলো তেত্রিশ’ গল্পে।