আমার মরহুমা ‘মমতাময়ী মা’ সায়্যিদা খায়রুন্নেসা হিজরী সন অনুযায়ী ১৩৮৮ হি. জুমাদাল উখরা ও খৃষ্টাব্দ মোতাবেক ৩১ আগষ্ট, ১৯৬৮ সালে এ নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। যিনি ছিলেন সৎস্বভাবী, খোদাভীরু ও ইবাদতগুজার মহীয়সী নারী। স্বরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর ব্যক্তিত্ব এ পৃথিবীর প্রতিটি গৃহবধুর জন্য এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্তস্বরূপ। তাঁর দৃঢ় ঈমান, আল্লাহপ্রেম, দুনিয়াবিমুখতা ও আখিরাতের প্রতি আগ্রহ ছিল কল্পনাতীত। সর্বক্ষেত্রে দুনিয়ার ওপর দীনকে প্রাধান্য দেয়া ছিল তাঁর স্বভাবসুলভ আচরণ। দুনিয়ার ধন-সম্পদ, পদ-মর্যাদা ও সাজ-সজ্জার প্রতি ছিল প্রবল অনীহা। নামাযের প্রতি ছিল তাঁর অন্তর্নিহিত নিবেদন। এক কথায় আল্লাহর হুকুম ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর তরীকা অনুযায়ী চলাই ছিল যার একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। দীন ও দীনদার লোকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ছিল তাঁর উত্তম আখলাকের এক অনুপম নিদর্শন। তৎকালীন ফেতনা-ফাসাদের যুগেও তাঁকে দেখে সহজেই অনুমান করা যেত, কেমন ছিলেন সাহাবী রমণীগণ ও ঈমানদার তাবেঈন ও তাবে’ তাবেঈন। আম্মার ইন্তিকালের দু’মাস পরই মাসিক ‘রিযওয়ান’ নামক পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়, যা ছিল মূলত তাঁর জীবনী, জীবনের বিভিন্ন ঘটনা এবং তাঁর মূল্যবান বাণী ও রচনাবলীর আলোচনাসম্বলিত একটি সংখ্যা। অল্প ক’দিনের মধ্যেই মাসিক ‘রিযওয়ান’ নামক সে সংখ্যাটি খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং এর সবগুলো কপি বিক্রি হয়ে যায়। এমনকি আজও অনেকে অন্যান্য গ্রন্থের মত মাসিক রিযওয়ানের সেই সংখ্যাটিকে সংরক্ষণ করে রেখেছেন। এখন যখন মরহুমার নির্বাচিত স্বরচিত দু’আর সংকলন (যা তাঁর জীবদ্দশায় প্রথমত ‘বাবে রহমত’ এবং পরবর্তীতে ‘কলীদে বাবে রহমত’ নামে দুই ভাগে প্রকাশিত ও জনপ্রিয় হয়েছিল) ভক্ত ও আগ্রহীদের আগ্রহ ও চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ‘কলীদে বাবে রহমত’ নামে পুনঃপ্রকাশ করা হচ্ছে। এ সংখ্যাটিই পুনঃনিরীক্ষা, যাচাই-বাছাই ও সংযোজন-বিয়োজনসহ ‘যিকরে খায়ের’ নামে প্রকাশ করা হয়। এর সবগুলো লেখা তাঁর নিকটাত্মীয় এবং রাত-দিন তাঁকে যারা দেখেছেন- বংশের সে সকল লোকের রচিত। আর এ সবই ‘রিযওয়ান’ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। তাই এ যুগেও আমি আশা করি, হযরত আবুল হাসান আলী নদভী রহ. এর ‘যিকরে খায়ের’ নামক গ্রন্থটি মূল্যবান হিসেবেই বিবোচিত হবে এবং আগ্রহভরে বারংবার পঠিত হবে। প্রতিদানস্বরূপ গ্রন্থের পাঠক-পাঠিকাদের কাছে মরহুমার আত্মার মাগফিরাত কামনা করতঃ জান্নাতে তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য দু’আ করার আবেদন রইল। আল্লাহ তা’আলা তাঁকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন। আমিন।
আল্লাহর পথের এক মহান দাঈ,ইলমে ওহীর বাতিঘর যুগশ্রেষ্ঠ মনীষী। খাঁটি আরব রক্তের গর্বিত বাহক।বিশ্বময় হেদায়েতের রোশনি বিকিরণকারী।উম্মতের রাহবর ও মুরুব্বি। কল্যাণের পথে আহ্বানে চিরজাগ্রত কর্মবীর। জন্ম ১৯১৪ ঈসাব্দে। ভারতের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার সূতিকাগার উত্তর প্রদেশের রাজধানী লাখনৌর রায়বেরেলীতে। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া আদ্যোপান্তই দারুলউলুম নদওয়াতুল উলামায়। অধ্যাপনা জীবনের সিংহভাগও এই প্রতিষ্ঠানে নিবেদিত ছিলেন। আল্লামা নদভীর খ্যাতির সূচনা হয় বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকে "সীরাতে সাইয়েদ আহমদ শহীদ" রচনার মাধ্যমে।গ্রন্থটি গোটা ভারতবর্ষে তাকে পরিচিত করে তুলে।এরপর তিনি রচনা করেন 'মা যা খাসিরাল আলামু বিনহিতাতিল মুসলিমিন' (মুসলমানদের পতনে বিশ্ব কী হারাল) নামক কালজয়ী গ্রন্থ।যা তাকে প্রথমত আরববিশ্বে ও পরবর্রতীতে বৈশ্বিক সুখ্যাতি এনে দেয়। এ পর্যন্ত গ্রন্থটির শতশত সংস্করণ বের হয়েছে। বিগত প্রায় পৌনে এক শতাব্দী ধরে তার কলম অবিশ্রান্তভাবে লিখেছে মুসলিম ইতিহাসের গৌরদীপ্ত অধ্যায়গুলোর ইতিবৃত্ত। সীরাত থেকে ইতিহাস, ইতিহাস থেকে দর্শন ও সাহিত্য পর্যন্ত সর্বত্রই তার অবাধ বিচরণ। উর্দু থেকে তার আরবী রচনায় যেন অধিকতর অনবদ্য। আল্লামা নদভী জীবনে যেমন পরিশ্রম করেছেন, তেমনি তার শ্বীকৃতিও পেয়েছেন। মুসলিম বিশ্বের নোবেল হিসেবে খ্যাত বাদশাহ ফয়সাল আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন।১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে দুবাইয়ে তিনি বর্ষসেরা আন্তর্জাতিক ইসলামী ব্যক্তিত্ব নির্বাচিত হন।১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক সেন্টারের পক্ষ থেকে আলী নদভীকে সুলতান ব্রুনাই এ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। আন্তর্জাতিক বহু ইসলামী প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সদস্য ছিলেন। তিনি একাধারে রাবেতায়ে আলমে ইসলামী এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক সেন্টারের সভাপতি ছিলেন। লাখনৌর বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুলউলুম নাদওয়াতুল-উলামা' এর রেকটর ও ভারতীয় মুসলনমানদের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফরম মুসলিম পারসোন্যাল ল' বোর্ডের সভাপতি ছিলেন। ইসলামের এই মহান সংস্কারক ১৯৯৯ সনের ৩১ ডিসেম্বর জুমার আগে সুরা ইয়াসিন তেলাওয়াতরত অবস্থায় ইন্তিকাল করেন।