যে কয়টি আত্মিক রোগ মানব জীবনে অকল্যাণ ও বিপর্যয় ডেকে আনে বিশেষ করে মানুষের আমল-আখলাক ও পরকালীন। জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তন্মধ্যে দু'টি রোগ হচ্ছে ‘হিংসা ও ‘গীবত। হিংসা এমন একটি আত্মিক রোগ, যে রোগ মানুষের কষ্টার্জিত আমলকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দেয়। হিংসাকারী হিংসার অনলে জ্বলে জ্বলে সে একদিন ধ্বংস হয়ে যায়। হাদীসের ভাষ্যমতে লাকড়ি বা শূকনো ঘাষে আগুন লাগলে যেমন লাকড়ী, বা ঘাষকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয়, তদ্রæপ হিংসাও মানুষের আমলকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয়। সুতরাং আমল বিনাসী এই রোগ থেকে বেঁচে থাকা আমাদের প্রত্যেকের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। ঠিক তদ্রæপ গীবত। গীবতের পরিণতি আরো ভয়াবহ। কারণ। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গীবতকে মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করার সাথে তুলনা করেছেন। তা ছাড়া গীবত করার দ্বারা গীবতকারীর আমল যার গীবত করা হচ্ছে তার। আমলনামায় স্থানান্তরিত হয়ে যায়। উপরন্তু গীবতের অপরাধ এটা হুকুকুল ইবাদ তথা বান্দার হকের অন্তর্ভুক্ত, যে অপরাধ স্বয়ং আল্লাহ তাআলাও ক্ষমা করবেন না, যতক্ষণ সংশ্লীষ্ট ব্যক্তি ক্ষমা করবে। এর দ্বারা গীবতের ভয়াবহতা এবং কদর্যতা সহজেই অনুধাবন করা যায়। অথচ আমাদের পরিবার ও সমাজ গীবতের এই মারাত্মক অপরাধে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। শুধু তাই নয় বরং গীবত যেন আজকে আমাদের নিকট ‘ঘী ভাতের চেয়েও বেশি মজাদার বিষয়। কারণ আমাদের সভাসেমিনার, আলোচনার কোন মজলিস গীবত ব্যতীত জমেই না। মজলিস গরম করার ক্ষেত্রে গীবত যেন একটি আবশ্যিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আর এই জন্য আমাদের অজ্ঞতাই হয়ত অনেকাংশ দায়ী। কারণ কারো অনুপস্থিতিতে তার আলোচনা কোন পর্যায়ে বৈধ হবে আর কোন পর্যায়ে অবৈধ বা গীবত বলে। গণ্য হয়, সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা আমাদের অনেকেরই হয়ত। নেই। আর ধারণা থাকলেও হয়ত এর ভয়াবহতা ও কদর্যতা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান নেই। ফলে আমরা নির্দ্বিধায় ও নির্বিঘেœ। এই জঘন্য পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়ি। সুতরাং হিংসা’ ও ‘গীবত এই মারাত্মক রোগ দু’টির কদর্যতা থেকে আমাদের পরিবার ও সমাজকে মুক্ত করার জন্য জোরালো পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। তার পূর্বে জেনে নেয়া প্রয়োজন পবিত্র ও কুরআন ও হাদীসের রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই রোগ দু’টি সম্পর্কে কিরূপ হুশিয়ারীবাণী উচ্চারণ করেছেন। সে প্রয়োজনের তাগিদেই আল্লামা তকী উসমানী সাহেবের ও ‘এসলাহী খুতবাতের ধারাবাহিকতায় এবার আমরা পাঠকের খেদমতে উপস্থাপন করছি, ‘হিংসা পতনের মূল’ এবং গীবত, একটি জঘন্য গুনাহ’ শীর্ষক দু’টি বয়ানের সরল অনুবাদ। অবশ্য বইটির নামকরণ করা হয়েছে প্রথমোক্ত বয়ানের শিরোনাম অনুসারে। আল্লাহ তাআলা একে ওসীলা করে এই মারাত্মক আত্মিক রোগ দু’টি থেকে আমাদের সকলকে বেঁচে থাকার তওফীক দান। করুন। পাশাপাশি এর অনুবাদক ও প্রকাশকসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে। উত্তম প্রতিদানে ধন্য করুন। আমিন।
তাঁর পূর্ণনাম মুহিউদ্দ্বীন আবু যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনুশ শায়েখ আবু ইয়াহইয়া মুররি ইবনে হাসান ইবনে হুসাইন ইবনে মুহাম্মদ ইবনে জুম‘আ ইবনে হেযাম আল-হেযামী আন-নববী। ‘মুহিউদ্দ্বীন’ তাঁর উপাধি এবং ‘আবু যাকারিয়া’ হলো কুনিয়াত তথা উপনাম। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি এতোটাই প্রসিদ্ধ ছিলেন এবং ইলম ও তাক্বওয়ার মানদণ্ডে এমন সমুন্নত হতে পেরেছিলেন যে, তাঁকে ‘মুহিউদ্দ্বীন মতান্তরে ‘মুহিউস্ সুন্নাহ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ৬৩১ হিজরীর মুহাররম মাসে দামেশকের নিকটবর্তী ‘নাওয়া’ নামক স্থানে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। জন্মস্থানের দিকে সম্পর্কিত করেই তাঁর নামের শেষে ‘নাওয়ায়ী’ বা ‘নববী’ উল্লেখ করা হয়। এ ব্যাপারটা স্বতঃসিদ্ধ ও প্রমাণিত যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর যেসব বান্দাদের দিয়ে দীন ও মানুষের মহান খেদমত করান, ছোটবেলা থেকেই তাদেরকে সেভাবেই গড়ে তোলেন। ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ’র ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। শৈশবে থেকেই তিনি ছিলেন আর সব শিশুদের চেয়ে আলাদা। অজপাড়া গ্রামে, নিম্নবিত্ত নিরক্ষর পরিবারে জন্ম নেওয়া সত্তে¡ও তাঁর সবটুকু ঝোঁক ছিলো ইলম অর্জনের দিকে। দোকানদার পিতা চাইতেন, ছেলে তার সাথে দোকানদারী করুক। কিন্তু তিনি পিতার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে দামেশকের ‘আর-রাওয়াহিয়্যাহ’ নামক প্রতিষ্ঠানে চলে যান ইলমের-অšে¦ষণে এবং আলেমদের সংস্পর্শে থাকার তাড়নায়। এখানে থেকেই তিনি ইলমের সবগুলো শাখায় নিজের উত্তরোত্তর ব্যুৎপত্তি ঘটান। ইমাম যাহাবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘তিনি (নববী) দিন-রাত্রির বেশির ভাগ সময় জ্ঞানার্জনে ব্যয় করতেন। মেধা ও পরিশ্রমের জন্য তাঁকে দিয়ে উদাহরণ পেশ করা হতো।’ সারাদিনে একবার খেতেন। এমনকি পথ চলার সময়টুকুতেও মনে মনে পড়া আওড়াতেন। ৬৫১ হিজরীতে একুশ বছর বয়সে তিনি পিতার সাথে হজ্জ পালন করার জন্য মক্কায় যান। এই সফরকালে তিনি মক্কা-মদীনার শ্রেষ্ঠ আলেমগণের সান্নিধ্যে আসেন এবং হাদীস শাস্ত্রে বিশেষ বুৎপত্তি অর্জন করেন। ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ যেসব ওস্তাদদের নিকট থেকে জ্ঞানার্জন করেছেন, তাঁদের মধ্যে মুহাম্মদ ইবনে আহমাদ আল-মাকদাসী, ইসমাইল ইবনে ইবরাহীম, আহমদ ইবনে আবদুদ্দায়েম, আবদুর রহমান আল-আন্বারী, ইবরাহীম ইবনে আলী আল-ওয়াসেতী প্রমূখ অন্যতম। ফিকহের ক্ষেত্রে নববী ছিলেন শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী। শুধু অনুসারীই নয়, বরং তিনি ছিলেন মাযহাবের প্রধান বিশ্লেষক ও ইমামদের একজন। ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘তিনি ছিলেন শায়খুল মাযহাব এবং তাঁর যমানার শ্রেষ্ঠতম ফকীহ’। যাহাবী বলেন, ‘তিনি ছিলেন মাযহাবের ব্যাখ্যাকারদের শিরোমনি’। তাঁর রচিত ‘রাওদাতুল ত্বালেবীন’কে শাফেয়ী মাযহাবের প্রধানতম ব্যাখ্যাগ্রন্থ ও তথ্যসূত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। অধিকাংশ শাফেয়ী আলেমদের মতো ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহও আকীদার ক্ষেত্রে ‘আশ‘আরী’ মতবাদের অনুসারী ছিলেন। যাহাবী, তাজউদ্দীন সুবকী, ইয়াফেয়ী-সহ তাঁর অপরাপর জীবনীকাররা এমনটাই উল্লেখ করেছেন। সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যায় তাঁর রচিত ‘আল মিনহাজ’ গ্রন্থে তিনি আশ‘আরী মতবাদসমূহকে ব্যাপকভাবে স্থান দিয়েছেন। ক্ষণজন্মা এই মহাত্মা বেঁচে ছিলেন মাত্র পয়তাল্লিশ বছর। কিন্তু এই স্বল্প সময়েও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে দিয়ে দীন ও ইলমের যে বিশাল খেদমত করিয়েছেন, তা সত্যিই বিরল। ইলমের প্রায় প্রতিটি শাখাতেই তাঁর রচিত গ্রন্থ রয়েছে, যেগুলো কেয়ামত পর্যন্ত মানুষকে উপকার দিয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ! বিশেষ করে ‘আল-আরবাঈন আন-নববীয়্যাহ’, ‘রিয়াদুস সালেহীন’ এবং ‘আল-আযকার’ এই তিনটি গ্রন্থ তো সর্বস্তরের মুসলিমের কাছেই সমানভাবে সমাদৃত এবং পঠিত। এছাড়া তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থাবলির মধ্যে অন্যতম হলো, (১) আল-মিনহাজ ফি শারহে মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ; (২) রাওদাতুল ত্বালেবীন ওয়া উমদাতুল মুফতীন; (৩) মিনহাজুল ত্বালেবীন ওয়া উমদাতুল মুফতীন; (৪) আদাবুল মুফতি ওয়াল মুসতাফতি; (৫) তুহফাতু তুল্লাবিল ফাদায়েল; (৬) আত-ত্বিবইয়ান ফি আদাবে হামালাতিল কুরআন। (৭) আত-তাহরীর ফি আলফাযিত তানবীহ; (৮) আল-উমদাহ ফি তাসহিহিত তানবীহ; (৯) আল ইদ্বাহ ফিল মানাসিক; (১০) আত তাইসীর ফি মুখতাসারিল ইরশাদ; (১১) ইরশাদু তুল্লাবিল হাক্বায়েক; (১২) আল-ফাতাওয়া; (১৩) আল মিনহাজ ফি মুখতাসারিল মুহাররার; (১৪) দাকায়েকুল মিনহাজ; (১৫) মুখতাসারু আসাদিল গাবাহ; (১৬) মানাকিবুশ শাফেয়ী; (১৭) মুহেম্মাতুল আহকাম; (১৮) রিসালাহ ফি ক্বিসমাতিল গানাঈম; (১৯) খুলাসাতুল আহকাম; (২০) বুসতানুল আরেফীন। এছাড়া তাঁর রচিত অসমাপ্ত গ্রন্থের সংখ্যাও কম নয়। তন্মধ্যে ‘আল মাজুমু শারহুল মুহায্যাব’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর মৃত্যুর পর ইমাম সুবকী রাহিমাহুল্লাহ এবং তারপর শায়েখ মুহাম্মদ নজীব এই গ্রন্থের রচনা সমাপ্ত করেন। এছাড়া ‘জামেউস সুন্নাহ’, ‘শারহুত ত্বানবীহ’, ‘শারহুল ওয়াসিত’, ‘শারহুল বুখারী’, ‘শারহু সুনানি আবু দাউদ’, ‘আল-আহকাম’ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। ৬৭৬ হিজরীর রজব মাসের চব্বিশ তারিখে পয়তাল্লিশ বা ছেচল্লিশ বছর বয়সে এই মনীষী ইন্তেকাল করেন। তাজউদ্দীন সুবকী রাহেমাহুল্লাহ বলেন, ‘তাঁর মৃত্যুতে দামেশক ও তদ্সংলগ্ন শহরগুলো শোকে ডুবে গিয়েছিলো।’ জন্মস্থান ‘নাওয়া’তেই তাঁকে দাফন করা হয়। মহান আল্লাহ তাঁকে এবং তাঁর সকল খেদমতকে কবুল করুন।