প্রত্যেক মুমিনের প্রিয়পাত্রী হযরত হালিমা সাদিয়া রাযি.। প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দুধমাতা। তিনি ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্না মহীয়সী নারী। তাঁর পবিত্র স্তন থেকেই দুগ্ধ পান করেছেন শিশু মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। ফলে তিনি হলেন ভাগ্যবতী ও সম্মানিতা। যিনি সা’দ গোত্র থেকে স্পষ্ট ও মিষ্টি ভাষা শিখে উপকৃত হয়ে আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ স্পষ্টভাষী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। ভাষা-অলংকার ও বাগ্মিতায় ছিলেন সর্বোত্তম ব্যক্তি। তিনিই জগদ্বিখ্যাত মহীয়সী নারী। তাঁর স্নেহ ও ভালোবাসাপূর্ণ বুকের ওপর কতকাল ঘুমিয়েছেন শিশু মুহাম্মাদ। তাঁর মাতৃ মমতার আদুরে কোলে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন। যে মহিমান্বিত শিশু এ বিশ^কে ভরপুর করে দিয়েছিলেন সদাচার ও করুণায়। যিনি কলুষিত পরিবেশকে পূর্ণ করেছিলেন মহত্ত¡ ও দিক-নির্দেশনায়। সজ্জিত করেছিলেন এ সমাজকে নৈতিকতা ও মর্যাদার অলংকারে। এ মহামানবকে সা’দ গোত্রীর মহীয়সী নারী হালিমা সাদিয়ার দুধপান করানোর পেছনে রয়েছে এক মনোমুগ্ধকর কাহিনী; যা তিনি তুলে ধরেছেন মনের মাধুরী মেশানো চিত্তাকর্ষক বর্ণনা ও মমতা জড়ানো ভঙ্গিমায়। চলো হারিয়ে যাই শিশু মুহাম্মাদের সেই আকর্ষণীয় গল্পচরিত্রে...। হযরত হালিমা সাদিয়া রাযি. এর চিত্তাকর্ষক সেই বর্ণনা- “আমি ও আমার স্বামী শিশুপুত্র মুহাম্মাদকে নিয়ে মক্কার উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হলাম দুগ্ধপোষ্য শিশুবাচ্চার খোঁজে। সেদিন আমাদের সঙ্গী হিসেবে ছিল স্বীয় গোত্র সা’দের আরও অনেক মহিলা। একই উদ্দেশ্যে। দুঃখজনক বিষয় হলো, বছরটি ছিল খরাকবলিত দুর্ভিক্ষের বছরে। যা ধ্বংস করে দিয়েছিল ফসল। ফলে দুগ্ধশূন্য ছিল পশুর ওলান। সেই দুর্ভিক্ষ এলোমেলো করে দিল আমাদের সবকিছুই। অক্ষত ছিল না তেমনকিছু। আমাদেরও ছিল বয়স পেরিয়ে যাওয়া শীর্ণ দুটো গাধী। একটিতে চড়লাম আমি ও আমার ছোট্ট শিশু আর অপরটিতে চড়লেন আমার স্বামী। আমার গাধীটি ছিল অধিক বয়স্কা এবং বেশি দুর্বল। আমাদের শীর্ণকায় বাহনের মন্থর গতির কারণে আমরা কাফেলা থেকে ধীরে ধীরে পেছনে পড়ে যাচ্ছিলাম। সফরসঙ্গীরা হচ্ছিলেন রুষ্ট ও বিরক্ত। কারণ আমাদের কারণে তাদের অবিরাম যাত্রা হয়ে যাচ্ছিল কষ্টকর। আল্লাহর কসম করে বলছি, তীব্র ক্ষুধার যন্ত্রণায় আমাদের শিশুপুত্রের বিরামহীন কান্নার কারণে আমরা এক মুহূর্তও ঘুমোতে পারতাম না। কেননা আমার বুকের সামান্য দুধে শিশুপুত্র পরিতৃপ্ত হতে পারত না। অপরদিকে আমাদের দুটি গাধীর ওলানেও তাকে খাওয়ানোর মতো পর্যাপ্ত দুধও ছিল না। অবশেষে অনেক কষ্টে আমরা পৌঁছে গেলাম মক্কা নগরীতে এবং প্রত্যেকেই খুঁজতে লাগলাম দুগ্ধপোষ্য শিশু। দেখা মিলল বুদ্ধিদীপ্ত শিশু মুহাম্মাদের। প্রত্যেক ধাত্রীর কাছে পেশ করা হলো শিশু মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহকে। বাদ দেওয়া হলো না কাউকেই। কিন্তু তাঁকে গ্রহণ করতে রাজি হলাম না আমরা কেউই। কারণ সে যে পিতৃহীন, এতিম! আমাদের নিষ্ঠুর মন তখন ভাবছিল, পিতৃহীন শিশুর মা কী দেবে আমাদের?! কী-ই বা পাব আমরা তাঁর দাদার কাছ থেকে?! এরপর মাত্র দুদিন না যেতেই আমার সকল সঙ্গিনী একটি করে দুগ্ধপোষ্য শিশু যোগাড় করে ফেলল। অপরদিকে খালি হাতেই আমাদের বাড়ি ফেরার ভাবনা চূড়ান্ত হয়ে গেল। আমি পড়ে গেলাম ভাবনায়। স্বামীকে বললাম, “দেখো! এভাবে শিশু না নিয়ে খালি হাতে ফিরে যাওয়া এবং নিজেদেরকে চরম অভাব ও দারিদ্র্যের মাঝে ঠেলে দেওয়া আমার ভালো লাগছে না। তাছাড়া আমার প্রতিটি সঙ্গিনীই একটি করে শিশু সঙ্গে নিয়ে ফিরছে। আমি এখনই যাচ্ছি এতিম বাচ্চাটির কাছে, তাকে নিয়ে তবেই ফিরব।” স্বামী আমাকে অনুমতি দিয়ে বললেন, “ঠিকাছে, অসুবিধা নেই যাও, তাকেই নিয়ে এসো। হয়তো এতেই আমাদের পালনকর্তা প্রভ‚ত কল্যাণ ও বরকত দান করবেন।” আমি সঙ্গে সঙ্গে পিতৃহীন সেই শিশুর মায়ের কাছে ছুটে গেলাম এবং ফিরে এলাম তাকে নিয়ে...। আল্লাহর কসম! আর কোনো শিশু না পাওয়ার কারণে তাঁকে নিয়েই ঘরে ফেরার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম। তাঁকে নিয়ে পৌঁছে গেলাম আমার কাফেলায়। অতঃপর আমার কোলে বসিয়ে তাকে দুধপানের উদ্দেশ্যে আড়াল হলাম। দুধহীন সেই স্তন আল্লাহর ইচ্ছায় ভরপুর হয়ে উঠল। শিশুটি খেয়ে পরিতৃপ্ত হলো। এরপর খেল তার ভাই। সেও হলো পরিতৃপ্ত। তারা দুজন ঘুমিয়ে যাওয়ার পর আমি এবং আমার স্বামী ক্লান্তদেহ এলিয়ে দিলাম বিছানায়। শুয়ে পড়লাম ঘুমানোর উদ্দেশ্যে। বেশ কিছুদিন যাবৎ শিশুপুত্রের ক্ষুধাজনিত কান্নার কারণে আমাদের কপালে ঘুমের সৌভাগ্য জোটে খুব সামান্যই। হঠাৎ আমার স্বামীর দৃষ্টি পড়ল আমাদের বয়স্কা ও শীর্ণকায় গাধী দুটির প্রতি। চোখে তার অবাক বিস্ময়। দেখা গেল ওদের ওলান দুটো স্ফীত ও দুধপূর্ণ। তিনি বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে এগিয়ে গিয়ে দুধ দোহালেন, পানও করলেন। তখনও যেন তিনি নিজের চোখদুটোকে বিশ্বাস করাতে পারছিলেন না। এরপর আমার জন্যও দোহালেন এবং আমিও পান করলাম। আমরা দুজনই অনেকদিন পর পরিতৃপ্ত হলাম। জীবনের সুখময় একটি রাত আমরা কাটালাম।
১৯২০ খ্রিস্টাব্দে উত্তর সিরিয়ার আরিহা শহরে জন্ম। জন্মের চার মাসের মাথায় বাবাকে হারান। চার বছর বয়সে মায়ের অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেলে দাদার কাছেই লালিত-পালিত হন। সিরিয়ার প্রাচীনতম শরয়ী শিক্ষাগার হালাব শহরের মাদরাসা খুরভিয়ায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পড়াশোনা করেন। তারপর মিসরের আল-আজহার ইউনিভার্সিটি থেকে অর্জন করেন উসূলে ফিক্হের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি। আল-আজহারে পড়াশোনা শেষ করে কায়রো ইউনিভার্সিটিতে আরবি ভাষা ও সাহিত্যের উচ্চতর গবেষণা সম্পন্ন করে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ড. আবদুর রহমান রা‘ফাত পাশা শিক্ষকতা, সাহিত্যসাধনা ও গবেষণাতেই জীবনভর সম্পৃক্ত ছিলেন। এক সময় দামেস্ক ইউনিভার্সিটির কলা অনুষদের প্রভাষক ছিলেন। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে সৌদি আরব সফরে গেলে রিয়াদের ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সউদ ইউনিভার্সিটি থেকে অধ্যাপনার প্রস্তাব পেয়ে সেখানেই স্থির হয়ে যান। আরবি ভাষার সেবা, সাহিত্যসাধনা ও গবেষণার পাশাপাশি মুহাম্মদ ইবনে সউদ ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে সেখানেই কাটিয়ে দেন জীবনের বাকি বাইশটি বছর। ইসলামি সাহিত্যের উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে ড. রা‘ফাত পাশা প্রধানত দুটো ভাগে কাজ করেছেন। এক. ইসলামের স্বর্ণযুগে রচিত দাওয়ামূলক কবিতা সম্ভারকে শিল্পের নিক্তিতে মেপে সমালোচনা। দুই. ইসলামের অতীত ইতিহাসকে খ্যাত ও বিস্মৃত মনীষীদের জীবনীর আদলে অনন্য রচনাশৈলিতে উপস্থাপন।জীবনী সাহিত্যে রা‘ফাত পাশা যে কাজগুলো করে গেছেন, তা আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। ‘সুয়ারুম মিন হায়াতিস সাহাবা’, ‘সুয়ারুম মিন হায়াতিস সাহাবিয়াত’ ও ‘সুয়ারুম মিন হায়াতিত তাবেয়িন’ শিরোনামের তিনটি গ্রন্থ তাঁকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এ ছাড়া ‘আদ-দীন আল-কাইয়িম’, ‘লুগাত আল-মুসতাকবিল’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ আরও বিপুল কাজ করে গেছেন তিনি। ৬৬ বছর বয়সে প্যারালাইসিসের কারণে ড. রা‘ফাত পাশার শরীরের একাংশ বিকল হয়ে যায়। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময় ডাক্তারের পরামর্শে কিছু দিনের জন্য হাওয়া বদলের উদ্দেশে তিনি তুরস্কের ইস্তাম্বুলে যান এবং সেখানেই জুলাইয়ের ১৮ তারিখ মুতাবেক ১১ জিলক্বদ ১৪০৬ হিজরী শুক্রবার রাতে ইন্তিকাল করেন। ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক ‘ফাতেহা’ গোরস্তানে তাঁকে সমাহিত করা হয়, যেখানে শুয়ে আছেন বিপুল সংখ্যক সাহাবী আজমাঈন ও তাবেয়িনে কেরাম।