পূর্বকথা দেওবন্দ থেকে প্রকাশিত ‘আল-আনসার’ পত্রিকার সম্মানিত সম্পাদক সাহেব মহিলাদের প্রচলিত পর্দা সম্পর্কে একটি প্রশ্নপত্র তৈরি করে হযরত হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানভী দা.বা. এর খেদমেত পাঠিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য, এ ব্যাপারে শরঈ বিধান জানা। হযরত এর অত্যন্ত সারগর্ভ ও দলিলনির্ভর পরিপূর্ণ একটি উত্তর লিখে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। যা ২৪ জুন ১৯২৮ সালের ‘আল-আনসার’ পত্রিকা ছেপেছিল। উত্তরটি দেখে কতিপয় দ্বিনদার ভাইয়ের অন্তরে আকাক্সক্ষা জাগে, এর একটি সহজ ব্যাখ্যা করা হোক। কারণ দ্বিন এবং উলূমে দ্বিন থেকে সর্বসাধারণের নির্লিপ্ততা এ পরিমাণ বেড়ে গিয়েছে যে, এখন দ্বিনী প্রবন্ধ-নিবন্ধ অনুধাবন করা মানুষের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই হযরত তাদের এই দরখাস্ত গ্রহণ করতঃ শ্রদ্ধেয় ভাই মৌলভী যাফর আহমদ (উসমানি) সাহেবকে এর সরল ব্যাখ্যা করার অনুমতি দেন। আমার মুহতারাম ভাই অত্যন্ত সুন্দরভাবে এর সহজ-সরল ব্যাখ্যা তৈরি করেন। পাশাপাশি মূল উত্তরাংশে হযরত নিজেও কয়েকটি জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় বৃদ্ধি করেছেন। সেই সাথে ‘পরিশিষ্ট’ ও ‘সংযোজন’ শিরোনামে দুটি লেখাও যুক্ত করে দিয়েছেন। অতএব, এখানে প্রথমে আল-আনসারের সম্পাদক সাহেবের প্রশ্নসমূহ, তারপর উত্তর ও তার ব্যাখ্যা পেশ করা হবে। আশা করি, এতটুকুতে সত্যসন্ধানীরা পরিতৃপ্তি হয়ে যাবে। তবে যারা পূর্ব থেকে বিশেষ চিন্তা-ভাবনা মনের মধ্যে বসিয়ে নিয়েছে, ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করে নির্লজ্জ হয়ে গিয়েছে; তাদের জন্য এরকম হাজার বই-পুস্তকও যথেষ্ট নয়! সুতরাং সম্মানিত পাঠক-পাঠিকাগণের নিকট আমাদের দাবি, পুরো প্রবন্ধটিকে ইনসাফের দৃষ্টিতে মনোযোগ দিয়ে পড়বেন। আর পর্দা, যা নারীজাতির গৌরব ও তাদের সতীত্বের রক্ষক; এতে অবহেলা করে নিজের দুনিয়া ও আখেরাত নষ্ট করবেন না! -আহকার মুদীর
হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী, ভারতীয় উপমহাদেশ এবং এর গন্ডি পেরিয়ে যিনি হাজারো মানুষকে দিয়েছেন আত্মশুদ্ধি ও তাসাওউফ এর শিক্ষা। যার কারণে তাঁর উপাধি ছিলো ‘হাকীমুল উম্মাত’ বা উম্মাহর আত্মিক চিকিৎসক। উপমহাদেশে মুসলমানদের মাঝে সুন্নতের জ্ঞান প্রচারে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংস্থা ‘দাওয়াতুল হক’ এর অবদানের জন্যও প্রসিদ্ধ মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর নাম। মাওলানা আশরাফ আলী থানভী ১৯ আগস্ট, ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে (রবিউস সানী ৫, ১২৮০ হিজরী) ভারতের উত্তর প্রদেশের থানাভবনে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই হাফেয হোসাইন আলী রাহ.-এর কাছে সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্থ করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর শিক্ষাজীবন। নিজগ্রামেই ছোটবেলায় হযরত মাওলানা ফতেহ মুহাম্মদ থানভী রাহ.-এর কাছ থেকে আরবি ও ফার্সি ভাষার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১২৯৫ হিজরীতে তিনি দারূল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের উচ্চতর শাখাগুলোয় বিচরণ করার আগ্রহে। সেখানে তিনি পাঁচ বছর হাদীস, তাফসীর, আরবি সাহিত্য, ইসলামী দর্শন, যুক্তিবিজ্ঞান, ইসলামি আইন এবং ইতিহাস বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। দেওবন্দে শিক্ষার অধ্যায় সমাপ্ত করে মক্কা মুকাররমায় মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ্ মুহাজিরে মক্কীর কাছে কেরাত ও তাজবীদ শেখেন। তিনি কানপুরের একটি মাদ্রাসায় মাত্র ২৫ টাকা বেতনে শিক্ষকের পদ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে কানপুরের টপকাপুরে জামিউল উলূম মাদ্রাসার প্রধান পরিচালকের আসন অলংকৃত করেন এবং দীর্ঘ ১৪ বছর সেখানে শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে তাঁর শিক্ষক হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কীর রহ. পরামর্শে তিনি থানা ভবনের খানকাহে ইমদাদিয়ায় অবস্থান গ্রহণ করেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। সারা জীবনে আশরাফ আলী থানভী এর সকল বই এর হিসেব করতে গেলে ছোট-বড় মিলিয়ে তা সাড়ে বারো হাজার ছাড়িয়ে যায়। হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. এর বই সমূহ এর মধ্যে ফিকাহ বিষয়ক বই ‘বেহেশতী জেওর’ উপমহাদেশের মুসলমানদের মাঝে বহুল পঠিত। এছাড়া তাঁর রচিত কুরআন শরীফের উর্দু তরজমার গ্রন্থ বয়ানুল কুরআনও (কুরআনের ব্যাখ্যা) এর ভাষা ও ব্যখ্যাশৈলীর জন্য প্রসিদ্ধ। হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. এর বই সমগ্র এর স্বত্ত্ব তিনি জাতির কল্যাণে উন্মুক্ত করে রেখে গেছেন। জুলাই ১৯, ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে (১৬ রজব, ১৩৬২ হিজরী) আল্লামা থানভী রহ. তাঁর জন্মস্থান থানা ভবনেই মৃত্যুবরণ করেন।