মানুষের মাঝে আল্লাহ তাআলা একটি চালিকাশক্তি দিয়েছেন, যার নাম হলো মন। আর এই মনের মাঝে রয়েছে প্রবৃত্তি বা আবেগ, যার চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে মানুষ নিজেকে বিপদে পতিত করে। অতএব, মন আর প্রবৃত্তিহীন যেমন কোনো মানুষ পাওয়া যায় না, তেমনইভাবে চাহিদাহীন কোনো প্রবৃত্তিও কারও মাঝে থাকতে পারে না। আর এই চাহিদা পূরণেই বাঁধে সব বিপত্তি। জীবনের গাইডলাইনহীন মানুষ শুধু দিগ্ভ্রান্ত ব্যক্তির মতো নিজের চাহিদা পূরণের জন্য লেগে থাকে। অথচ আল্লাহ তাআলা নবী দাউদ আলাইহিস সালামকে লক্ষ করে বলেন : “তুমি প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না, তাহলে এই প্রবৃত্তি তোমাকে আল্লাহর রাস্তা থেকে বিচ্যুত করবে। নিশ্চয়ই যারা হিসাবনিকাশের দিবস ভুলে গিয়ে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হবে, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।” মোটকথা, মানুষ মানেই তার মাঝে তাড়নাপ্রবণ একটি প্রবৃত্তি রয়েছে। আর সেই প্রবৃত্তি ভালো-মন্দ উভয় পথেই পরিচালিত হয়। তবে মানুষের হাতেই থাকে এর নিয়ন্ত্রণ। যেমন, আমাদের মাঝে প্রচলন আছে, ‘মানুষ অভ্যাসের দাস।" কিন্তু কথাটি যদি এভাবে বলি, ‘অভ্যাস মানুষের দাস’, তাহলেও কিন্তু অসংগতিপূর্ণ কিছু বলা হয় না। অর্থাৎ, মানুষ অভ্যাসকে যেদিকে নেবে, অভ্যাস সেদিকেই যাবে, যখন যা বলবে তখন তা-ই করবে এবং হবে। ঠিক এরকমই হলো প্রবৃত্তি। শুধু প্রবৃত্তির তাড়না বা চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, নিয়ন্ত্রণ করা জানতে হবে। আর সঠিক পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে যেই প্রবৃত্তির কারণে কেউ কেউ নিন্দিত হচ্ছে, সেই একই প্রবৃত্তির কারণে আপনি-আমি স্রষ্টা ও সৃষ্টির কাছে নন্দিত হব। তো ইসলাম যেমন একজন মানুষের বাহ্যিক সংস্কার কামনা করে এবং এজন্য দিক-নির্দেশনা দেয়, অনুরূপ অভ্যন্তরীণ প্রবৃত্তিকে সুস্থ করে তুলতে এবং সঠিক পথে পরিচালিত করতেও বিশেষ গাইডলাইন প্রদান করে। আর প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রণ এবং তাকে যথাযথভাবে দুনিয়া-আখেরাতের কল্যাণে ব্যবহার করার সেই গাইডলাইনগুলো আমাদের সালাফগণ কুরআন কারিম ও হাদিস শরিফ থেকে সংকলন করেছেন, যার মধ্যে অন্যতম হলো ইমাম ইবনুল জাওযি রহিমাহুল্লাহ-এর রচিত যাম্মুল হাওয়া বা প্রবৃত্তির নিন্দাচার।
আল্লামা ইবনু কাইয়্যিমিল জাওযীয়া (রহঃ) ছিলেন ইসলামী চিন্তাবিদ, ফকিহ, তাফসীরবিদ, হাদীসজ্ঞ এবং চিকিৎসাশাস্ত্রের পণ্ডিত। তাঁর পূর্ণ নাম ছিল আবু আব্দুল্লাহ্ শামসুদ্দ্বীন মুহাম্মাদ বিন আবু বকর বিন আইয়্যুব আদ দিমাশকী। তিনি ৬৯১ হিজরী সালে দামেস্কে জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর পিতা দীর্ঘ দিন দামেস্কের আল জাওযীয়া মাদ্রাসার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বলেই তাঁর পিতা আবু বকরকে قيم الجوزية কাইয়্যিমুল জাওযীয়াহ অর্থাৎ মাদরাসাতুল জাওযীয়ার তত্ত্বাবধায়ক বলা হয়। পরবর্তীতে তাঁর বংশের লোকেরা এই উপাধীতেই প্রসিদ্ধি লাভ করে। ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমীয়া (রহঃ)-এর স্নেহধন্য শিষ্য ছিলেন এবং শাইখের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি তাঁর সাথেই ছিলেন। এমনকি জিহাদের ময়দান থেকে শুরু করে জেলখানাতেও তিনি তাঁর থেকে আলাদা হননি। তিনি ইসলামী আকীদাহ, তাওহীদ, সুন্নাহ ও বিদআত-বিরোধী বিভিন্ন বিষয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। তার মধ্যে তাওহীদ ও সুন্নাহের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, বিদআতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং ইবাদত-বন্দেগীতে নিষ্ঠা ছিল অন্যতম। ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:
"যাদুল মা‘আদ ফী হাদ্য়ী খাইরিল ইবাদ"
"মাদারিজুস সালিকীন"
"শিফাউল আলীল"
"তিবেব নববী" (চিকিৎসাশাস্ত্রে তাঁর অনন্য অবদান)
তাঁর উস্তাদ বৃন্দ -
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) যে সমস্ত আলেম-উলামার কাছ থেকে তালীম ও তারবীয়াত হাসিল করেন, তাদের মধ্যে রয়েছেনঃ
শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমীয়াহ (রহঃ)।
আহমাদ বিন আব্দুদ্ দায়িম আল-মাকদেসী (রহঃ)।
তাঁর পিতা কাইয়্যিমুল জাওযীয়াহ (রহঃ)।
আহমাদ বিন আব্দুর রহমান আন্ নাবলেসী (রহঃ)।
তাঁর ছাত্রসমূহ -
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) এর হাতে যে সমস্ত মনীষী জ্ঞান আহরণে ধন্য হয়েছিলেন, তাদের তালিকা অতি বিশাল। তাদের মধ্যে রয়েছেনঃ
বুরহান উদ্দ্বীন ইবরাহীম বিন ইবনুল কাইয়্যিম।
ইমাম ইবনে রজব (রহঃ)।
হাফিয ইমাম ইবনে কাছীর (রহঃ)।
তিনি একজন নিরলস সাধক, যিনি দীর্ঘ সময় ইবাদত করতেন, বিশেষ করে তাহাজ্জুদ ও কুরআন তিলাওয়াতে মগ্ন থাকতেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ইলমী ও আধ্যাত্মিক খেদমত মুসলিম উম্মাহর জন্য অমূল্য দান হয়ে রয়েছে। ইবনুল কাইয়্যিম ৭৫১ হিজরী সনে মারা যান এবং দামেস্কের বাবে সাগীর গোরস্থানে তাঁর পিতার পাশে দাফন করা হয়।