হযরত থানবি রহিমাহুল্লাহ মুসলমানদের অবগত করানোর জন্য সহজ-সরল ভাষায় ঈমানের শাখাগুলু লিপিবদ্ধ করেন। যাতে মুসলিমরা যে ঈমানের দাবি করে, সেটার কতগুলো শাখা রয়েছে, আর সেগুলোর মধ্যে ক’টা পালন করছে আর ক’টা লঙ্ঘন করছে জানতে পারবে এবং এর ফলে ঈমান কতটা পূর্ণাঙ্গ হয়েছে, আর কতটা ত্রুটিপূর্ণ রয়েছে, তা অনুধাবন করা পারবে। আর যেসব শাখার অভাব নিজেদের মধ্যে দেখবে, সেগুলো পূরণ করার চেষ্টা করতে পারবে। তা পূরণ করার আগে নিজেদের পূর্ণ মুমিন দাবি করতে তারা লজ্জা অনুভব করবে। যদিও দীনের মৌলিক বিষয়গুলো মেনে নিলে নিম্ন স্তরের ঈমান আনা হয়ে যায়, তবে তা অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ। যেমন অন্ধ, বধির, বিকলাঙ্গ ব্যক্তিকেও মানুষ বলা হয়। সবারই জানা আছে, এরূপ ব্যক্তি কেমন মানুষ। ঈমানের এসব শাখার সংকলন দ্বারা আরেকটি উদ্দেশ্য হলো, অন্যান্য ধর্মের লোকেরাও যেন জানতে পারে, ইসলামের শিক্ষা হলো পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা। আর ইসলাম তাকেই পরিপূর্ণ মুসলমান মনে করে, যার মধ্যে এসব উত্তম চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান রয়েছে। অসম্পূর্ণ মুসলমানদের অবস্থা দেখে কেউ যেন ইসলামকে অসম্পূর্ণ ও অমর্যাদার মনে না করে। কারণ, ইসলামের কাজ হলো মানুষদের সঠিক পথের ঠিকানা দেওয়া। জোড় করে সেরূপ বানিয়ে দেওয়া নয়। যদি কোনো মুসলিমের মধ্যে কোনো ত্রুটি থাকে, তা হলে সেটার জন্য দায়ী সে নিজে, ইসলাম নয়।
হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী, ভারতীয় উপমহাদেশ এবং এর গন্ডি পেরিয়ে যিনি হাজারো মানুষকে দিয়েছেন আত্মশুদ্ধি ও তাসাওউফ এর শিক্ষা। যার কারণে তাঁর উপাধি ছিলো ‘হাকীমুল উম্মাত’ বা উম্মাহর আত্মিক চিকিৎসক। উপমহাদেশে মুসলমানদের মাঝে সুন্নতের জ্ঞান প্রচারে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংস্থা ‘দাওয়াতুল হক’ এর অবদানের জন্যও প্রসিদ্ধ মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর নাম। মাওলানা আশরাফ আলী থানভী ১৯ আগস্ট, ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে (রবিউস সানী ৫, ১২৮০ হিজরী) ভারতের উত্তর প্রদেশের থানাভবনে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই হাফেয হোসাইন আলী রাহ.-এর কাছে সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্থ করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর শিক্ষাজীবন। নিজগ্রামেই ছোটবেলায় হযরত মাওলানা ফতেহ মুহাম্মদ থানভী রাহ.-এর কাছ থেকে আরবি ও ফার্সি ভাষার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১২৯৫ হিজরীতে তিনি দারূল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের উচ্চতর শাখাগুলোয় বিচরণ করার আগ্রহে। সেখানে তিনি পাঁচ বছর হাদীস, তাফসীর, আরবি সাহিত্য, ইসলামী দর্শন, যুক্তিবিজ্ঞান, ইসলামি আইন এবং ইতিহাস বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। দেওবন্দে শিক্ষার অধ্যায় সমাপ্ত করে মক্কা মুকাররমায় মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ্ মুহাজিরে মক্কীর কাছে কেরাত ও তাজবীদ শেখেন। তিনি কানপুরের একটি মাদ্রাসায় মাত্র ২৫ টাকা বেতনে শিক্ষকের পদ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে কানপুরের টপকাপুরে জামিউল উলূম মাদ্রাসার প্রধান পরিচালকের আসন অলংকৃত করেন এবং দীর্ঘ ১৪ বছর সেখানে শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে তাঁর শিক্ষক হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কীর রহ. পরামর্শে তিনি থানা ভবনের খানকাহে ইমদাদিয়ায় অবস্থান গ্রহণ করেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। সারা জীবনে আশরাফ আলী থানভী এর সকল বই এর হিসেব করতে গেলে ছোট-বড় মিলিয়ে তা সাড়ে বারো হাজার ছাড়িয়ে যায়। হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. এর বই সমূহ এর মধ্যে ফিকাহ বিষয়ক বই ‘বেহেশতী জেওর’ উপমহাদেশের মুসলমানদের মাঝে বহুল পঠিত। এছাড়া তাঁর রচিত কুরআন শরীফের উর্দু তরজমার গ্রন্থ বয়ানুল কুরআনও (কুরআনের ব্যাখ্যা) এর ভাষা ও ব্যখ্যাশৈলীর জন্য প্রসিদ্ধ। হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. এর বই সমগ্র এর স্বত্ত্ব তিনি জাতির কল্যাণে উন্মুক্ত করে রেখে গেছেন। জুলাই ১৯, ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে (১৬ রজব, ১৩৬২ হিজরী) আল্লামা থানভী রহ. তাঁর জন্মস্থান থানা ভবনেই মৃত্যুবরণ করেন।