কি আশ্চর্য! মুনীর চৌধুরীর অন্যতম ও সর্বাধিক-পঠিত নাটক 'কবর' যে গ্রন্থে সন্নিবেশিত, সেই গ্রন্থের তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ হয়েছিল ৪০ বছর আগে। তিনটি নাটকসংবলিত 'কবর' বইটি বইয়ের বাজারে পাওয়া যায় না, যদিও 'কবর' নাটকটি নানাভাবে সংগ্রহযোগ্য। কাগজে-কলমে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ তারও ১০ বছর আগে। কাগজে-কলমে কেন উল্লেখ করা হলো, তার ব্যাখ্যা তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকায় মুনীর চৌধুরীর সহধর্মিণী লিলি চৌধুরী নিজেই দিয়েছেন, যা এই সংস্করণে সংযুক্ত আছে। ইতিমধ্যে মা লিলি চৌধুরী এবং পারিবারিক গুরুজন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, দুজনেই প্রয়াত। তাই বাবা-মা'র কনিষ্ঠ উত্তরসূরি আমিই চতুর্থ সংস্করণের ভূমিকা লেখার দায়িত্ব পালন করলাম। 'কবর' বইটিতে মুনীর চৌধুরী রচিত তিনটি নাটক আছে-যথাক্রমে 'মানুষ' (১৯৪৭), 'নষ্ট ছেলে' (১৯৫০) ও 'কবর' (১৯৫৩)। বইটি প্রথম চট্টগ্রাম বুক ক্লাব থেকে ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত। বইটি উৎসর্গিত তাঁর বোন নাদেরা বেগমকে (১৯২৯-২০১৩), যার বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। মুনীর চৌধুরীর বাম রাজনৈতিক অনুপ্রেরণায় ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত নাদেরা বেগম সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন, পাশাপাশি বড় দুই ভাই কবীর চৌধুরী ও মুনীর চৌধুরীর অনুপ্রেরণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে কৃতিত্বের সাথে এমএ করেন। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের চোখে ধুলো দিয়ে কখনো আত্মগোপন, কখনো কারাগারে থেকেও আন্দোলনের কারণে নাদেরা বেগম ৫০ দশকের নারী নেতৃত্বের বিরল দৃষ্টান্ত। সম্ভবত 'নষ্ট ছেলে' নাটকটি নাদেরা বেগমের কিংবদন্তিতুল্য জীবন ও সময়ের অভিজ্ঞতাপ্রসূত মুনীর চৌধুরীর সৃষ্টিশীল প্রয়াস। 'মানুষ' নাটকটিও ১৯৪৭-এর দাঙ্গার বিরুদ্ধে মুনীর চৌধুরীর সক্রিয় ভূমিকার ছায়া বহন করে। 'কবর' নাটকের উপজীব্য যে মুনীর চৌধুরীর ভাষা সৈনিক হিসেবে অভিজ্ঞতার সৃষ্টিশীল ফসল, সে কথা বলাই বাহুল্য। চতুর্থ সংস্করণের খুঁটিনাটি পরামর্শের জন্য মুনীর চৌধুরী পরিবারের পুত্রবধূ মিশুক মুনীরের স্ত্রী মঞ্জুলী কাজীকে ধন্যবাদ। সর্বশেষে হাওলাদার প্রকাশনীর কাছে কৃতজ্ঞতা 'কবর' বইটি নতুনভাবে প্রকাশের প্রস্তাব করার জন্য।
আবু নয়ীম মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী (২৭ নভেম্বর ১৯২৫ - ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১) একজন বাংলাদেশি শিক্ষাবিদ, নাট্যকার, সাহিত্য সমালোচক, ভাষাবিজ্ঞানী, বাগ্মী এবং শহিদ বুদ্ধিজীবী। তিনি তৎকালীন ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস নোয়াখালী জেলার চাটখিল থানাধীন গোপাইরবাগ গ্রামে। তিনি ছিলেন ইংরেজ আমলের একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খান বাহাদুর আবদুল হালিম চৌধুরীর চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়। কবীর চৌধুরী তাঁর অগ্রজ, ফেরদৌসী মজুমদার তাঁর অনুজা। ১৯৪৯-এ লিলি চৌধুরীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। মুনীর চৌধুরী ১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল (বর্তমান ঢাকা কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করেন এবং ১৯৪৩ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগে আইএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স (১৯৪৬) এবং মাস্টার্স (১৯৪৭) পাস করেন, উভয় ক্ষেত্রেই দ্বিতীয় শ্রেণীতে। তিনি ছিলেন সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র। বক্তৃতানৈপুণ্যের সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবনের প্রথম বছরেই, ১৯৪৩ সালে, হলের সেরা বক্তা হিসেবে প্রোভোস্ট্স কাপ জেতেন। ১৯৪৬ সালে নিখিল বঙ্গ সাহিত্য প্রতিযোগিতায় সর্বাধিক সংখ্যক পুরস্কার জেতেন। ১৯৪৯ সালে মুনীর চৌধুরী খুলনার ব্রজলাল কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে তিনি কিছুদিন বাংলাও পড়িয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালে মুহম্মদ আবদুল হাই অকালে মৃত্যুবরণ করলে তাঁর স্থানে মুনীর চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান হন। ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত একটি ভাষাতাত্ত্বিক সম্মেলনে যোগ দিতে যান। মুনীর চৌধুরী ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে পাকিস্তান সরকারের হাতে বন্দী হন। বন্দী থাকা অবস্থায় তিনি তাঁর বিখ্যাত নাটক কবর রচনা করেন (১৯৫৩)। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের যে কোন ধরনের সংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। ১৯৬৬ সালে রেডিও ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান প্রচারে পাকিস্তান সরকারের নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদ করেন। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার বাংলা বর্ণমালাকে রোমান বর্ণমালা দিয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নিলে তিনি এর প্রতিবাদ করেন। ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে সে আন্দোলনের সমর্থনে সিতারা-ই-ইমতিয়াজ খেতাব বর্জন করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুনীর চৌধুরী ফিরে আসার কিছুকাল পরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তাঁর কিশোর ছেলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে চলে যায়। এসময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আদেশে মে-জুন মাসে ইংরেজি বিভাগের প্রধান হিসেবে এবং জুলাই মাস থেকে কলা অনুষদের ডীন হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর মুনীর চৌধুরীকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীদের সহযোগী আল-বদর বাহিনী তাঁর বাবার বাড়ি থেকে অপহরণ করে ও সম্ভবত ঐদিনই তাঁকে হত্যা করে। তবে এর কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায় নি।