কীর্তনের আসরে কিংবা রামায়নের আসরে দোতারা দেখলে গানের চেয়ে ঐ বাজনাটার দিকেই আমার মন বেশি ঝুঁকতো। এই ভালোলাগা থেকেই দোতারা শিখতে আগ্রহী হই। শিখতে গিয়ে একটা ব্যাপার খেয়াল করেছি, অধিকাংশ দোতারাবাদক যত চমৎকার বাজান তত চমৎকার শেখাতে পারেন না। কারণ তাঁরা যেভাবে শিখেছেন হয়ত সেটা বিধিসম্মত শিক্ষণপদ্ধতি ছিলো না। আবার অনেকে আছেন যারা নিজেকে ছাড়া অন্যকে ভালো দোতারাবাদক বলতে নারাজ। কেউ কেউ বলেন দোতারা অনুগতসিদ্ধ যন্ত্র, এটা শেখা এত সহজ নয়। কেউ কেউ বলেন, দোতারা এত শেখার কি আছে! এ তো একদিনেই শেখা যায়। এতসব কথাবার্তা বিভিন্ন জনের কাছে শুনে আমি দোতারা শেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। একসময় আমি নিখিল কৃষ্ণ মজুমদার মহাশয়ের কাছে ম্যান্ডোলিন শেখা শুরু করি। তখন দেখি, তিনি শাস্ত্রীয়সংগীত কিংবা শাস্ত্রীয়যন্ত্র বাঁশির শিক্ষণ পদ্ধতির সাথে তাল মিলিয়ে দোতারাতেও স্বতন্ত্র শিক্ষণপদ্ধতি প্রচলন করেছেন। ফলে যেকোনো শিক্ষার্থী খুব সহজেই এ রীতিতে দোতারা শিখতে পারে বা পারছে। শুধু শিক্ষণপদ্ধতিই নয়, নিখিল কৃষ্ণ মজুমদার তাঁর দীর্ঘদিনের গবেষণার মাধ্যমে সুন্দর দোতারা তৈরি করেন, যেখানে সূক্ষ্ম মাপজোখের প্রয়োগে সুরের স্বাতন্ত্র স্পষ্টই দৃশ্যমান। দোতারাকে মানুষের কাছে সহজ ও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা এবং সহজে শেখার জন্য দোতারা নির্মাণ ও বাদনশিক্ষাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি এ গ্রন্থে। এক্ষেত্রে আমি বেশ কয়েকজন দোতারা নির্মাতার নির্মাণ ও বাদন কৌশল পর্যালোচনা করলেও, প্রাধান্য দিয়েছি আমার যন্ত্রশিক্ষাগুরু নিখিল কৃষ্ণ মজুমদার প্রবর্তিত নির্মাণ কৌশল ও বাদনশিক্ষা পদ্ধতিকে। এ গ্রন্থে দোতারার প্রতি কৌতুহলহেতু আমি সংক্ষিপ্তাকারে দোতারা সম্পর্কে কিছু কথা লেখার চেষ্টা করেছি, যার মাধ্যমে পাঠক দোতারার সামান্য ইতিহাস ও প্রাচীনতা সম্পর্কেও সামান্য ধারণা পাবেন। খুলনা অঞ্চলে যারা দোতারা বাজিয়ে নাম করেছিলেন বা এখনও দোতারাবাদনের সাথে যুক্ত আছেন তাদের মধ্যে কয়েকজনের সামান্য পরিচয়ও তুলে ধরার চেষ্টা করেছি এ গ্রন্থে। গ্রন্থটি রচনা করতে গিয়ে আমি বেশ কিছু মানুষের কাছে অনেক ঋণী। বিশেষত লোকযন্ত্রপ্রেমি নিখিল কৃষ্ণ মজুমদার, অধ্যাপক শংকর কুমার মল্লিক, অধ্যাপক স্বপন নাথ, ছোটভাই উৎপল বিশ্বাস, দোতারাবাদক শেখ মশিউর রহমান সুমন, অধ্যাপক সফিয়ার রহমান, অধ্যাপক ফরিদ ইসলাম, সাহিত্য গবেষক বিভূতিভূষণ মণ্ডল, লোকযন্ত্রপ্রেমি আব্দুল্লাহ আল-মামুন, চিত্রশিল্পী সুকুমার রায়, আমার স্ত্রী ঐশী মণ্ডল প্রমুখ। তাদের সকলকে আমি আমার আন্তরিক ধন্যবাদসহ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। দোতারা আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির সাথে মিশে থাকা বাঙালির একান্ত নিজস্ব লোকজ-যন্ত্র, তাই সভ্য সমাজে এ নিয়ে আরও ভালো চর্চা হোক, দোতারা ও দোতারাশিল্পীরা পূর্ণ মর্যাদা পাক এই কামনা করি।