পার্থ মল্লিকের লেখায় যে প্রতিবাদী দিকটা তা খুব প্রকট নয়। তবে তাঁর কবিতায় রয়েছে গভীর জীবনবোধ। যা আমাদেরকে দিয়ে যায় এক অনির্বচনীয় অনুভূতি । জীবনের আনন্দ-বিষাদে মাখানো এ এক অন্য অবলোকন: 'এখনও জমে ওঠেনি যাত্রাগানের আসর। শুনেছি সীতার মেকাপ বাক্স চুরি হয়ে/ গেছে। সে কোনো সিঁদেল চোর হবে। যদি তার দেখা পাও, তাকে বলে দিয়ো/ এই হলুদ রঙের চিঠি আমি তাকেই লিখেছি। তার অপেক্ষায় থেকে থেকে ঝরে/ গেছে সাদা লাউফুল। এখানে পাখির দেহ থেকে অনবরত ঝরে যাচ্ছে মাটির পালক। কারো দেখা না পেয়ে, শুধু দুপুর কুড়িয়ে নিয়ে আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে বালিকা। অথচ সে/ জানল না আজও, শিমুলের লাল সেঁটে আছে তার চুলে। আমি যেতে যেতে দেখেছি, চুমু খেয়ে খেয়ে কোনো এক প্রেমিকের ঠোঁট হয়ে/ গেছে বাদমী রঙের। সে জানতেও পারেনি, তার প্রেমিকা সবুজ রঙের হাসি/ হয়ে হাওয়ায় ভেসে গেছে। আমি দেখেছি মাঝির হৃদয়, আচমকা জলরঙ / মিশিয়ে সে কোনো এক বাউলের গান ধরে। আমি স্বপ্ন দেখি না, অথচ আমার/ ঘুমের ভেতরে মানুষ রঙের পাখিরা খুব ওড়াওড়ি করে।" (মানুষ রঙের পাখিরা) কবির অন্তর্দৃষ্টি, চিত্রকল্প, রূপকল্প কত প্রখর! এটুকু পাঠ করে আমরা হয়ত বলব, এ কোনো পরিণত কবির পরিমিত কাব্যবোধ। কিন্তু এটাই সত্য যে, এমন ধরনের জীবনচেরা পঙক্তি বাইশ বা তেইশ বছর বয়সের এক তরুণের লেখা! পার্থ মল্লিক স্বপ্ন ও সম্ভাবনার কবি। যে সম্ভাবনা নিয়ে বাংলা কবিতায় তাঁর আগমন; সে সম্ভাবনার পরিণতি ঘটল না। তাঁর কবিতা পাঠ করতে করতে কখনও মনে হয় সে জীবনানন্দীয় ঘোরে ঘূর্ণয়মান নিঃশঙ্ক ঝড়ের যাত্রী। পার্থর মত তরুণের দোষ কি? জীবননানন্দ দাশ বাংলা কবিতার এমনই এক বিস্ময়, সমগ্র বাংলা কবিতায় তাঁর যে প্রভাব, তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে আমাদেরকে আরও কতকাল প্রচেষ্টা চলিয়ে যেতে হবে, কে জানে! নিরন্তর চর্চার মধ্য দিয়ে একজন কবি তাঁর নিজস্বতাকে প্রতিষ্ঠা দেন। পার্থর জন্য পৃথিবী সে সময়টুকু দেয়নি। কবিতা, গান মিলিয়ে পার্থ মল্লিকের দুহাজারের মত রচনা রয়েছে। একজন প্রতিভাবান-সম্ভাবনাময় তরুণের এসব রচনা সংরক্ষিত না হলে তা হয়ত একদিন তলিয়ে যাবে কালের নিষ্ঠুর আবর্তে। আমরা চেষ্টা করছি, পার্থ মল্লিকের সব লেখা নিয়ে একটি সমগ্র প্রকাশ করার। তার আগে ওর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের কথা ছিল। পার্থ নিজেই এই পান্ডুলপি প্রস্তুত করে রেখেছিল। ওর একমাত্র ছোটবোন প্রত্যাশা মল্লিকের একান্ত আগ্রহ ও প্রচেষ্টায় সেটি এবার প্রকাশিত হচ্ছে। তারপর শুরু হবে সমগ্রের কাজ। ওর যা লেখালেখি আছে, ওর পরিচিতজন, বন্ধুদেরকে বলব, সেগুলো একটি জায়গায় এনে আমাদের কাজে সহযোগিতা করার জন্য। সবার আন্তরিকতা থাকলে আশা করি কাজটি আমরা সম্পন্ন করতে পারব। আমার কাছে চকচকে এক দুঃখের নাম পার্থ মল্লিক। পৃথিবীতে ওর আসা আর যাওয়া ঠিক যেন সন্ধ্যাতারার মত, যা ক্ষণিকেই মিলিয়ে যায়। কিন্তু আকাশ জুড়ে রেখে যায় তার অনাবিল দ্যুতি। সেই দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ুক পাঠকের অন্তরে। এই কাব্যগ্রন্থ পার্থর পরিচয়-পরিচিতিকে আরও বিস্তৃত করুক। সমাদৃত হোক সবার কাছে, এই প্রত্যাশা।