সে যখন আসমানের দিকে তাকাল, তখন সেই উত্তপ্ত চোখের বাষ্পে শুকিয়ে গেল মেঘ, সমস্ত কোলাহলময় চরাচর হয়ে উঠল মৃতের মতন স্তব্ধ, তার দিকে তর্জনী তুলে দেখাচ্ছিল যে যুবকেরা, তাদের সেই শানিত আঙুল মুহূর্তে কুঁকড়ে যাওয়া কাগজের মতো হয়ে উঠল। সবাই বিস্মিত হয়ে দেখল, যে চিতাবাঘ দাঁত হারিয়ে মুখ থুবড়ে ছিল খড়ের গাদায়, সে বিপুল শক্তি সঞ্চয় করে দাঁড়িয়েছে পৃথিবীর সামনে।...' খোঁড়া দৌড়বিদ বাংলা সাহিত্যে বাস্তববাদী ছোটোগল্পকারের সংখ্যা হয়তো কম নেই, তবে নাসরীন জাহানের মতো জীবন অবলোকনের সূক্ষ্মদর্শিতা ও ভাবপ্রকাশের শানিত দীপ্তি খুব কম গল্পকারের লেখায় চোখে পড়ে। পাঠককে নিছক বিনোদিত করার কাজে তিনি কখনোই নিজেকে নিয়োজিত করেননি। তিনি গল্পের চালচিত্রে নিপুণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন মানুষের ব্যক্তিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবস্থান। ব্যক্তিভেদে রসভেদ কিংবা রুচিভেদ হতে পারে বলেই এই গ্রন্থের গল্প নির্বাচনে হাত দিয়েছেন গল্পকার স্বয়ং। যেকোনো গল্পের পটভূমি ও স্বকীয়তা সম্পর্কে তাঁর ভাবনাই চূড়ান্ত। তথাপি প্রতিটি গল্প নির্বাচনে গল্পকারের প্রাজ্ঞ ও কুশলী মনোভাব পাঠকের দৃষ্টি এড়াবে না। নাসরীন জাহানের স্বনির্বাচিত গল্পে নির্বাচিত হয়েছে পঞ্চাশটি ছোটোগল্প। প্রথম খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে হীরকদ্যুতিসম পঁচিশটি গল্প।
নাসরীন জাহান ১৯৬৪ সালে ৫ মার্চ বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাটে জন্মগ্রহণ করেন। একজন বাংলাদেশী লেখক, ঔপন্যাসিক, এবং সাহিত্য সম্পাদক। আশির দশকের শুরু থেকে তিনি লেখালেখি শুরু করেন। তার বাবা গোলাম আম্বিয়া ফকির ছিলেন সরকারী চাকুরিজীবী ও মা উম্মে সালমা ছিলেন গৃহিণী। বাবার চাকরীর কারণে থাকতেন মামাবাড়িতে। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে তাকে আর তার ভাইকে ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় তাদের এক মামীর বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে ভর্তি হন শানকিপাড়া স্কুলে। যাতায়াতের সুবিধার জন্য থাকতেন ফুফুর বাড়িতে। ফুফুর এক মেয়ে ছিল শবনম জাহান। ফুফু তার নামের সাথে মিল রেখে মা-বাবার দেয়া নাম নাসরীন সুলতানা পরিবর্তন করে তার নাম রাখেন নাসরীন জাহান। স্কুলে পড়াকালীন পারভিন সুলতানা নামে এক বন্ধুর সাথে তার সখ্য গড়ে উঠে। সে বিদ্যাময়ী সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়-এ ভর্তি হলে তিনিও একই স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৭৭ সালে শিশু একাডেমি থেকে লেখা চাওয়া হলে দুই বান্ধবী লেখা পাঠায়। দুজনের লেখা প্রকাশিত হয় সেই পত্রিকায়। ব্যক্তিগত জীবনে নাসরীন জাহান কবি আশরাফ আহমেদের স্ত্রী। লেখালেখির সূত্রেই তার সাথে পরিচয় এবং সে থেকে প্রণয়। ১৯৮৩ সালে তারা বিয়ে করেন। তাদের এক মেয়ে। নাম অর্চি অতন্দ্রিলা। নাসরীন জাহান পাক্ষিক পত্রিকা অন্যদিনের সাহিত্য সম্পাদক। ১৯৯৭ সাল থেকে তিনি এই পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি উড়ুক্কু উপন্যাসের জন্য ১৯৯৪ সালে ফিলিপ্স সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন।