সিলেট কেন্দ্রিক স্মৃতিচারণমূলক নিবন্ধের বই ‘স্মৃতির সিলেট’। ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতীক // সিলেটের কিনব্রিজ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কিছু কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা আছে যার নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে ভাসে সেই শহরের ছবি যেখানে সেই স্থাপনার অবস্থান। সেই সব স্থাপনাকে সেই শহরের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। যেমন আইফেল টাওয়ার। আইফেলের নাম শুনলেই চোখে ভাসে প্যারিস নগর আর সিন নদী। টাওয়ার ব্রিজের কথা মনে হলেই চোখে ভাসে লন্ডন সিটি আর টেমস নদী। তাজমহলের নাম শুনলেই মনে পড়ে আগ্রা শহর আর যমুনা নদীর কথা। চার্লস ব্রিজের ছবি দেখলে বা নাম শুনলে চোখে ভাসে বিশ্ব ঐতিহ্য প্রাগ নগর আর ভস্নাতুভা নদীর ছবি। চেইন ব্রিজের নাম শুনলে বা ছবি দেখলে চোখে ভাসে বুদাপেস্ট আর দানিয়ুব নদীর দৃশ্য। তেমনই আমাদের শহর সিলেটেরও রয়েছে সে রকমের ঐতিহ্যবাহী প্রতীক আর স্থাপনা। আর সেটা হলো সুরমা নদীর উপর স্থাপিত ঐতিহ্যবাহী কিনব্রিজ। কিনব্রিজের ছবি দেখলে বা নাম শুনলে বাংলাদেশের মানুষের চোখে ভাসে পুণ্যভূমি সিলেটের ছবি। কিনব্রিজের অবস্থান সিলেট শহরের দক্ষিণ প্রান্তে সুরমা নদীর উপর। লোহা দিয়ে তৈরি ধনুকের ছিলার মতো বাঁকানো সেতু এই কিনব্রিজ। ব্রিটিশ আমলে তৎকালীন আসাম প্রদেশের গভর্নর মাইকেল কিন—এর সিলেট সফর উপলক্ষ্যে তৎকালীন আসাম সরকারের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য রায় বাহাদুর প্রমোদ চন্দ্র দত্ত সি আই ই এবং আসামের শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদের প্রচেষ্টায় ১৯৩৩ সালে ব্রিজটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ১৯৩৬ সালে কাজ শেষে ব্রিজটি চালু হয়। গভর্নর মাইকেল কিন—এর নামানুসারে ব্রিজটির নামকরণ করা হয়। কিনব্রিজের দৈর্ঘ্য ১১৫০ ফুট আর প্রস্থ ১৮ ফুট। ব্রিজটির পুরো অবকাঠামো লোহা দিয়ে তৈরি। তখনকার আমলে কিনব্রিজ তৈরিতে ব্যয় হয়েছিল ৫৬ লাখ টাকা। কিনব্রিজ চালু হওয়ার পর ব্রিজ পারাপারের জন্য জন্য প্রতিবার জনপ্রতি এক পয়সা হারে টোল আদায় করা হতো। যানবাহনের জন্যও ছিল বিভিন্ন হারে টোল আদায়ের বিধান। গবাদি পশু পারাপারেও দিতে হতো টোল। অবশ্য চার বছর পর ১৯৪০ সালে টোল প্রথা বাতিল হয়ে যায়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হানাদার পাক বাহিনী ডিনামাইট দিয়ে কিনব্রিজের উত্তরপাড়ের একাংশ উড়িয়ে দেয়। স্বাধীনতার পর কাঠ ও বেইলি পার্টস দিয়ে বিধ্বস্ত অংশটি মেরামত করে হালকা যানবাহন ও পথচারীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ের সহযোগিতায় বিধ্বস্ত অংশটুকু কংক্রিট দিয়ে পুনর্নিমান করা হয়। এর পর কয়েক বছর পূর্বে এম সাইফুর রহমান অর্থ ও পরিকল্পণামন্ত্রী থাকাবস্তায় কিনব্রিজে কিছু সংস্কার কাজ করা হয়। তখন ব্রিজকে দৃষ্টিনন্দন করতে ব্রিজের দুই দিকের প্রবেশ মুখে দুটি বৃহৎ আকারের তোরণ নির্মাণ করা হয়। এতে কিনব্রিজের মূল কাঠামো কিছুটা পরিবর্তন হয়ে যায়। সংস্কার ও সঠিক রক্ষণা বেক্ষণের অভাবে ব্রিজটির কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই অনেক দিন থেকে ভারী যানবাহন চলাচল করতে পারে না। পথচারী এবং হালকা যানবাহন চলে। ২০১৯ সালে আগস্ট মাসে ঐতিহ্যের এই সেতু সংরক্ষণ করতে যান চলাচল বন্ধ করা হয়। কিনব্রিজকে ঘিরে বিকল্প পরিকল্পনা করেছিল সিলেট সিটি করপোরেশন। ঝুঁকিপূর্ণ এই সেতু দিয়ে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে পদচারী সেতুতে পরিণত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে সেতুর দুই মুখে লোহার বেষ্টনী লাগিয়ে বন্ধ করা হয় যান চলাচল। কিন্তু দক্ষিণ সুরমাবাসীর আপত্তির মুখে সেই উদ্যোগ সফল হয়নি। লোহার বেষ্টনী ভেঙে ফেলা হয়। এখন আবার নড়বড়ে ব্রিজ দিয়ে পদচারীর সঙ্গে যানবাহন চলাচল করছে। বিভিন্ন সময়ে ঐতিহাসিক এই ব্রিজটি সংস্কার ও সৌন্দর্য বর্ধনের উদ্যোগ নিলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। অবশেষে ২০২৩ সালের ১৫ আগস্ট থেকে দুই মাসের জন্য সেতুটি বন্ধ রেখে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের তত্ত্বাবধানে সেতুটি সংস্কার করা হয়। ঐতিহাসিক তথ্যমতে গত শতকের ত্রিশের দশকে আসাম প্রদেশের গভর্নর মাইকেল কিন—এর সিলেট সফরকে স্মরণীয় করে রাখতে এই ব্রিজ নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৩৩ সালে। ১৯৩৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে জনসাধারণের চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। মাইকেল কিন ১৯৩২ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের আসাম প্রদেশের গভর্নর ছিলেন। আর সিলেট ছিল আসামে একটি জেলা শহর। একটি সেতু এভাবেই একটি অঞ্চলকে চিহ্নিত করে রেখেছে প্রায় পঁচাশি বছর ধরে। কিনব্রিজ সিলেট অঞ্চলের দীর্ঘতম নদী সুরমার উপর নির্মিত প্রথম সেতু। ঐতিহ্যের গৌরব আর গরিমায় যা আজও ঠিকে আছে এ অঞ্চলের প্রতীক হিসেবে। তাই কিনব্রিজ আজ সিলেটবাসীর ভালোবাসার অহংকার।